
১৯ জুলাই ২০২৪ দুপুরটা ছিল রোদঝলমলে, কিন্তু বাতাসে ছিল অস্থিরতা। উত্তাল আন্দোলনের মাঝে অনেকেই গেয়েছিল নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন, কেউবা হাতে নিয়েছিল প্ল্যাকার্ড, কেউবা কলম। কিন্তু উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের এক শান্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরী নাঈমা সুলতানা জানত না, সেদিনই থেমে যাবে তার কিশোর স্বপ্ন। এক ছোঁ মেরে জীবন কেড়ে নেবে রাষ্ট্রীয় বুলেট। মোবাইলে ভিডিও করছিলেন রাস্তায় চলমান আন্দোলনের দৃশ্য। ঠিক সেই মুহূর্তে ছুটে আসে একটি গুলি, সরাসরি আঘাত করে তার মাথার বাম পাশে।
হাসিনার আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর বুলেট শুধু তরুণ প্রাণ কেড়ে নেয়নি, শতাধিক শিশু-কিশোরকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা একটি আরেকটিকে ছাপিয়ে যায়।
নাঈমার মা আইনুন বেগম বললেন, ‘মেডিকেলের সামনে থেকে আমার মেয়েকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। গুলিটা লাগার সঙ্গে সঙ্গে নাঈমা কোনো শব্দ করেনি। মেঝেতে পড়ে যায়। আমি দৌড়ে যাই। ওকে ডাকতে ডাকতে মাথা তুলতেই দেখি রক্ত আর মগজ আমার হাতে লেগে গেছে।’
ঘটনার দিন নাঈমার হাতে থাকা মোবাইলে ধরা পড়ে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার সেই মর্মান্তিক দৃশ্য। ভিডিওটি এখন একটি নীরব সাক্ষী, রাষ্ট্রীয় সহিংসতার, নিষ্পাপ প্রাণহানির।
জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলোতে মেয়েকে বাসার বাইরে যেতে দিতেন না মা। তবে নাঈমা চুপ থাকেনি। নিজের ঘর থেকেই অনলাইনে চালাত প্রতিবাদের প্রচারণা। ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে সক্রিয় ছিল বন্ধুদের সঙ্গে।
আইনুন বেগম বলেন, ‘নাঈমা বলতো, উত্তরার যারা আন্দোলনে আসবেন, কেউ যদি আহত হন বা খাবারের দরকার হয়, তারা যেন ৬ নম্বর সেক্টরের ডিমার্স কোচিং সেন্টারে যান। ওখানে শুকনো খাবার, পানি আর প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী রাখা আছে।’ বন্ধুদের জন্য এমন প্রস্তুতি নেয়া নাঈমা নিজে জানতো না, মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছে একজন কিশোরী।
নাঈমা ছিল তিন ভাইবোনের মেজো। বড় বোনের সঙ্গে এক ঘরে থাকতেন। এখন সে ঘর আর খোলা হয় না। ওই ঘরের দরজা এখনো যেন অশ্রুতে বন্ধ।
মেয়ে হারিয়ে শুধু বেদনা নয়, অস্পষ্ট ক্ষোভও ঝরে পড়ে আইনুন বেগমের কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘শহীদ ফ্যামেলির মধ্যে যাদের লোক আছে, তারা উপদেষ্টাদের সঙ্গে বারবার দেখা করছে। কেউ কেউ ৮ থেকে ১০ বারও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছে। আর আমরা একবারও পারিনি। তাহলে এটাও কি বৈষম্য না?’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে, তবুও বৈষম্য যায়নি। যে বৈষম্য দূর করতে আমার মেয়ে লড়েছে, সেই বৈষম্য আজও জীবিত।’