
রাজশাহীতে অবৈধভাবে ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অনুমতি নিয়েও নকশাবহির্ভূতভাবে বা অনুমোদন ছাড়া একের পর এক ভবন গড়ে উঠছে এ নগরীতে।
গত ২০ বছরে এমন সাড়ে ছয় হাজার ভবন মালিককে চিঠি দিয়েছে আরডিএ। কিন্তু অবৈধ এসব ভবনের একটিও ভাঙার কার্যক্রম হাতে নিতে পারেনি তারা। ৭০টি মামলা বিচারাধীন থাকলেও সেগুলোতে নিজেদের পক্ষে রায় নিয়ে আসতে পারছে না আরডিএ।
অভিযোগ উঠেছে, আরডিএর ভেতরেই একটি চক্র ভবন মালিকদের পক্ষে গিয়ে আইনি জটিলতা তৈরি করে। আরেকটি চক্র অবৈধ ভবনগুলোর মালিকদের থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিষয়গুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে পরিকল্পিত নগরী গড়ে তুলতে যেমন বেগ হচ্ছে, তেমনি ভবন নিয়ে বাড়ছে ঝূঁকি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১৮ সালে গঠিত হয় আরডিএ। রাজশাহী সিটি করপোরেশন, উপজেলার নওহাটা পৌরসভা, কাটাখালী পৌরসভা, দামকুড়া, হড়গ্রাম, হরিপুর, হুজুরিপাড়া, হরিয়ান, বড়গাছি, পারিলা ইউনিয়ন, চারঘাট উপজেলার চারঘাট পৌরসভা (আংশিক), এ উপজেলার ইউসুফপুর ও সলুয়া ইউনিয়ন এবং পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর ও বানেশ্বর মিলে মোট ১৫টি প্রশাসনিক এলাকা নিয়ে আরডিএ বিস্তৃত। এর মধ্যে রাজশাহী শহরে এখন পর্যন্ত অনুমোদিত ভবন গড়ে উঠেছে প্রায় ২৫ হাজার।
সূত্র আরো জানায়, আরডিএ মূলত ১৯৮০ সালের পর থেকে নকশা ছাড়া অবৈধভাবে নির্মিত ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে নোটিশ করতে শুরু করে। তবে কেবল প্রতিবেশীরা যেসব ভবন নিয়ে অভিযোগ করে, সেসবের বিরুদ্ধেই নোটিশ পাঠানো হয়। সেই হিসাবে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ভবন মালিককে নোটিশ করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর তেরোখাদিয়া এলাকায় ফুটপাতের কিছু অংশ দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে পাঁচতলা ভবন। এই ভবনটির কোনো অনুমোদনই নেননি ভবন মালিক সারোয়ার উদ্দিন। ফলে এই ভবনটি ভেঙে ফেলার জন্য গত ১৩ জানুয়ারি মালিককে নোটিশ করে আরডিএ। নির্মীয়মাণ ওই ভবনটির মালিক আইন ভঙ্গের বিষয়টি স্বীকার করে লিখিতও দেন পরের দিন। কিন্তু আজও তা ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারেনি আরডিএ। এমনকি জবাব দেওয়ার পরে ওই অবৈধ ভবনটির নিচের দুইতলা পর্যন্ত নির্মাণকাজও সম্পন্ন হয়ে গেছে। বাকি অংশেও কাজ চলছে।
জানতে চাইলে ভবন মালিক সারোয়ার উদ্দিন বলেন, ‘আরডিএ চাইলে ভেঙে দেবে। আমি আমার কাজ করছি। আমার জমি তো আমি ফেলে রাখতে পারব না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১১ সালে রাজশাহী নগরীর সবচেয়ে জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সাহেব বাজারে ‘এসএস টাওয়ার’ নামের একটি বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয় ৯ তলা পর্যন্ত। কিন্তু ভবন মালিক অতিরিক্ত আরো দুইতলাসহ মোট ১১ তলা নির্মাণ করেন। আরডিএ বর্ধিত দুইতলা ভাঙার নির্দেশ দিলে বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। আরডিএ মামলাটি করলেও নিম্ন আদালতে রায় পান ভবন মালিক সাজ্জাদ হোসেন। পরে আরডিএ মহানগর জজ আদালতে আপিল করে। সেই মামলাটি এখনো চলছে।
ভবন মালিক সাজ্জাদ হোসেন দাবি করেন, ‘আমাকে প্রথমে ১২ তলা পর্যন্ত নো অবজেকশন দেওয়া হয়। কিন্তু পরে নকশা অনুমোদন দেওয়া হয় ৯ তলা পর্যন্ত। এ কারণেই নিম্ন আদালতে আমি রায় পেয়েছি। আশা করে জজ আদালতেও আমার পক্ষে রায় যাবে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাকে দুই ধরনের অনুমোদন দিল কেন তারা? এর দায়ভার তো তাদেরই। এখন ভবন ভাঙতে বললেই তো আর হবে না।’
নগরীর ঘোড়ামারা এলাকায় ‘গ্রিন প্যালেস’ নামের একটি সাততলা ভবনে ১৮৫০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট চার বছর আগে কেনেন জনৈক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, এ ভবনের ডেভেলপার মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে তিনি ফ্ল্যাটটি কেনেন। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার আশায় ফ্ল্যাটটি কিনে পরে রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে দেখা যায়, এর অনুমোদন আছে ১৭২০ স্কয়ার ফিটের। বাকি ১৩০ স্কয়ার ফিট অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে ওই ফ্ল্যাট মালিক ব্যাংক লোন না পেয়ে বেকায়দায় পড়ে যান।
এ নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ডেভেলপার মোস্তাফিজুর রহমানকে বর্ধিত অংশ ফেলে ফেলার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেই নির্দেশনা আর বাস্তবায়ন হয়নি।
এসব বিষয়ে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সার্বিক বিষয়ে আমার মন্তব্য করার এখতিয়ার নেই। তবে বলতে পারি, অবৈধ ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ পেলে বসে থাকি না। তাঁদের ভবনের অবৈধ অংশ ভেঙে ফেলার নোটিশ জারি করা হয়। কখনো কখনো মামলাও হয়। তবে নানা কারণে হয়তো অবৈধ ভবন ভেঙে ফেলা যাচ্ছে না। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে কিছু চক্র।’