
চলতে চলতে পথ শেষ হয়,বলতে বলতে কথা শেষ হয়, প্রশাসনে থাকা ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর আমলাদের ভালোবাসা শেষ হচ্ছে না. বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের কিছু উপদেষ্টারা সেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী-লীগ সরকারের দোসর আমলাদের সেই ভালোবাসা শেষ হচ্ছে না দেশের বিখ্যাত শিল্পী রুণা লায়লা এবং এন্ড্রু কিশোর গানের কথা যেন ঠিক হয়ে যাচ্ছে প্রশাসনে। ফ্যাসিস্ট এর দোসররা এখনও পুরুস্কৃত হচ্ছেন! ওএসডি বা বাধ্যতামূলক অবসর নয়, বরং ‘সচিব’ হিসেবে পদোন্নতি পাচ্ছেন! বলে জনপ্রশান মন্ত্রণালয়ের একাধিক বঞ্চিত কর্মকর্তারা এমন অভিযোগ তুলেছেন।
অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে আট সচিব পদ শুণ্য রয়েছে। মাসের পর মাস এসব পদ শুণ্য থাকলেও যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সচিব পদে অতিরিক্ত সচিবকে রুটিন দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিচালনা করা হচ্ছে। দক্ষতার অভাবে দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিপূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। এজন্য বিভিন্নক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও ধীরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। দীর্ঘদিন শূণ্য থাকায় মেধাবী ও যোগ্যরা পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন। মন কষ্ট নিয়ে অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। গত বছর ৫ আগস্টে ক্ষমতাচ্যুৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে অনেকের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে তারা পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। সচিব পদোন্নতি তারা ১১ মাসেও পাননি।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালিন সরকার গঠনের পর তারা তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে সচিব পদোন্নতি পাবেন এমনটি প্রত্যাশায় ছিলেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে পদোন্নতি না পেয়ে তাদের কেউ কেউ অবসরে চলে গেছেন। তবে পদোন্নতি দেওয়ার লক্ষ্যে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভায় সচিবদের ফিটলিস্ট প্রস্তুত করা হয়। এক ডজন অতিরিক্ত সচিবের নাম রাখা হয়েছে। সেটির বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ায় শুণ্যসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিচালনায় সক্ষমতা নিয়ে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তেমনি ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে খোদ সরকার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ে সচিব পদায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিব পদ শূন্য থাকা অবস্থায় পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি না পেয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন। এতে সরকারের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এপ্রেক্ষিতে শূণ্যসচিব পদে দ্রুত নিয়োগ দিতে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) দিয়েছেন জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির সভাপতি, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড.সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ দিকে অর্থ উপদেষ্টার চিঠি আমলে নিচ্ছে না জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বলে অভিযোগ করছেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা। অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বার বার তাগেদা দেয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতির আবেদন গুলো যাচাই-বাচাই করতে একটি সভা অনুষ্ঠিত বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, শিগগিরই শূন্য থাকা সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে চারটি এসএসবির সভায় ১২ জনকে সচিব পদের জন্য বাছাই করা হয়েছে। স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে কর্মকর্তা নির্বাচন করতে হয়েছে। অধিকাংশই বঞ্চিত ও যোগ্যরাই সচিব পদোন্নতি পাবেন।
ডিওতে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, সরকার গত ৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটি গঠন করেছে। অন্যান্য কাজের সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে পদায়নের সুপারিশ করা এ কমিটির অন্যতম একটি কাজ। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ে সচিব পদায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে সরকার এ সংক্রান্ত কমিটির মাধ্যমে সচিব পদায়নের জন্য একটি ফিটলিস্ট প্রণয়ন করেছেন। উক্ত ফিটলিস্ট হতে সচিব পদায়নের সুপারিশ করা হবে। ফিটলিস্ট হতে আপনার মন্ত্রণালয়/বিভাগে সচিব পদায়নের বিষয়ে তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেছেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ শূণ্য থাকায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীর গতিতে। শূণ্য পদে অতিরিক্ত সচিব রুটিন দায়িত্ব পালন করলেও তাদের নির্বাহি ক্ষমতা না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকছে। শূণ্য থাকা উল্লেখযোগ্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হচ্ছে- দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (সচিব), জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সচিব), ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব), জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির রেক্টর (সচিব), জাতীয় সংসদ সচিবালয়, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়, ডাক,তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। গত কয়েক মাস ধরে বলা হচ্ছে,চলতি সপ্তাহে শূণ্য সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। সেই গানের মতো চলতে চলতে পথ শেষ হয়,বলতে বলতে কথা শেষ হয় না বলে একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর আমলা অতিরিক্ত সচিব রশিদুল হাসানকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার জন্য একটি চক্র পাঁয়তারা করছে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রকাশ্য সমর্থনকারী এই কর্মকর্তাকে কেন এখনও ওএসডি বা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়নি, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও এর আগে তিনি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ওবায়দুল কাদেরের সবচেয়ে প্রিয় ও আস্থাভাজন লোক ছিলেন। নোয়াখালীতে ওবায়দুল কাদেরের বাড়ির কাছেই রশিদুল হাসানের বাড়ি। ছাত্র জীবন থেকেই ওবায়দুল কাদেরের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল বলেও জানা গেছে। মূলত ছাত্রাবস্থা থেকেই ওবায়দুল কাদেরের গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল রশিদুল হাসানের। ক্ষমতায় থাকাকালে ওবায়দুল কাদের তাকে সেতু বিভাগে যুগ্মসচিব (প্রশাসন) ও অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্ব দেন। বঞ্চিতদের অভিযোগে বলা হয়,অফিস সময়ের পরেও ওবায়দুল কাদেরের বাসায় ছিল তার অবাধ যাতায়াত। বিসিএস (গণপূর্ত) ক্যাডারের ১৫ ব্যাচের দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তা ঘুষ বাণিজ্য এবং তোষামোদীর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তৎকালীন সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে কব্জা করে ফেলেন। তার অপতৎপরতায় তৎকালীন সেতু সচিবরাও ছিলেন অসহায়। কার্যতঃ তিনি-ই সচিবের ভূমিকা পালন করতেন। ওবায়দুল কাদেরের সকল অপকর্মের তিনি ছায়া সংগী ছিলেন। ওবায়দুল কাদেরের ওপর ভর করে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট খুনি হাসিনার কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলেন। তিনি প্রকৌশলী হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সেতু ভবন-কে কিভাবে লুটপাট করা যায় তা টার্গেট করে ও ওবায়দুল কাদেরের ওপর ভর করে ‘ঘুষ এবং দুর্নীতি’র মাধ্যমে প্রাপ্ত অবৈধ অর্থ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। তার মত ফ্যাসিস্ট সরকারের একজন দোসরের নাম সচিবের তালিকায় উঠে আসায় সিভিল প্রশাসনের সাধারণ সদস্যগণ হতাশা প্রকাশ করেছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় তিনি দীর্ঘ ৫ বছর ধরে সেতু বিভাগে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। ঐ সময়ে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার ভয়ে তটস্থ ছিলেন। ওই সময় তার কথা না শোনায় অনেকেই শাস্তিমুলক বদলির শিকার হয়েছেন বলেও জানা গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সেতু বিভাগ থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়ারও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রশিদুল হাসানের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মো. ফিরোজ মিয়ার জানান,বিগত তিনটি নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। সামনের নির্বাচনে দেশের তরুণ ভোটাররাসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ভোট দিতে প্রবলভাবে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। একটি সুষ্ঠু ও দক্ষ জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।রাজনৈতিক সরকারের সময় পদোন্নতির ক্ষেত্রে বেশ চাপ থাকে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এ ধরনের কোনো চাপ নেই বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। যেসব কর্মকর্তা সৎ, দক্ষ, সাহসী ও উদ্যমী এবং যাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির রেকর্ড নেই পদোন্নতির ক্ষেত্রে এসএসবি ওইসব কর্মকর্তার বিবেচনায় নিলে প্রশাসন নিরপেক্ষ শক্তিশালী হবে।