Image description
সোহাগ হত্যাকাণ্ড

লোমহর্ষক একটি হত্যাকাণ্ডে স্তব্ধ পুরো দেশ। বিচারের দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ সর্বত্র। মানুষের মুখে মুখে প্রশ্ন কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এর কারণই বা কী? কীভাবে ঘটেছে এই হত্যাকাণ্ড। মানবজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে জানার চেষ্টা করেছে এসব প্রশ্নের উত্তর। অন্যান্য ‘দিনের মতো গত বুধবার মিটফোর্ডের রজনী বোস লেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সোহানা মেটালে অবস্থান করছিলেন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯)। তখনও ওই লেনের বায়তুল ফালাহ মসজিদে নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলেন আশপাশের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা। মসজিদের পাশের ভবনের নিচতলায় সোহাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সাড়ে ৫টার কিছু পরে ২৫/৩০ জন ব্যক্তি একসঙ্গে সোহানা মেটালের সামনে গিয়ে ‘ধর ধর’ বলে সোহাগের ওপর হামলা চালায়। সবাই হায়েনার মতো একসঙ্গে কিল, ঘুষি, লাথি দিতে দিতে সোহাগকে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের দিকে চলে যায়। সেখানে গিয়ে মারতে মারতে হাসপাতালের তিন নম্বর গেটের ছোট পকেট গেট দিয়ে তারা সোহাগকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানেও বেধড়ক পেটানো ও কোপানো হয়। পাথর দিয়ে নৃশংসভাবে মাথা থেঁতলে দেয়া হয়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও অর্ধনগ্ন লাশের উপর উঠে উল্লাস করে খুনিরা। প্রথমদিকে ঘটনা তেমন জানাজানি না হলেও দু’দিন পর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওতে সোহাগকে মারার নৃশংস বর্বরতা দেখে আঁতকে ওঠে মানুষ। পাশবিক ওই ঘটনা দেখে নিন্দা ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি করে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেশব্যাপী প্রতিবাদ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা নাই। বরং ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কারা বসবে না বসবে এবং কিছু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। 

নির্মম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী: নিহত সোহাগ মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসার সঙ্গে পুরনো বৈদ্যুতিক সাদা তার কেনাবেচার ব্যবসা করতেন। সোহানা মেটাল নামে মিটফোর্ড এলাকার চায়নাপট্টি ও রজনী বোস লেনে তার দুটি দোকান রয়েছে। নিহত সোহাগ এবং মহিন পূর্বপরিচিত ছিলেন। ওই এলাকায় বিদ্যুতের তামার তার ও সাদা তারের ব্যবসার একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। তামার তার ও সাদা তারের অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল মহিন, অপু, টিটু, যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টুসহ মিটফোর্ড হাসপাতালের একটি চক্র। তারা অবৈধ বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল। তা না হলে নিয়মিত মাসে ২ লাখ টাকা চাঁদা দেয়ার দাবি জানিয়েছিল তারা। এই দ্বন্দ্বের জেরে সোহাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুলিও করে দুর্বৃত্তরা। এর পরে তিনদিন সোহাগ দোকান খুলেনি।

মহিন-অপুর নেতৃত্বে চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট: সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার নেতৃত্বদানকারী যুবদলের বহিষ্কৃত নেতা মাহমুদুল হাসান মহিন এবং একই থানা ছাত্রদলের বহিষ্কৃত নেতা অপু দাসের ছত্রছায়ায় মিটফোর্ড এলাকায় চাঁদাবাজির ভয়ঙ্কর এক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী, ফুটপাথ, সব জায়গায় চাঁদাবাজি চলতো। তারা দু’জনের নেতৃত্বে ৫ই আগস্টের পর থেকে মিটফোর্ড ও পাশের এলাকায় প্রকাশ্য চাঁদাবাজি হতো। চাঁদাবাজিতে সক্রিয় ছিল ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা দাবি করা অনেকে। তাদের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কারণ চাহিদামতো টাকা না দিলে আর চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ব্যবসায়ীদের মারধর করা হতো। প্রকাশ্যে অস্ত্র বের করে হুমকি দেয়া হতো। চাঁদা না দিলে দোকান বন্ধ করে দেয়া হতো। কেউ চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করলে তাকে নির্যাতন করা হতো। থানা পুলিশ এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে জানলেও নীরব থাকতো। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, মিটফোর্ড এলাকায় চাঁদাবাজির ভাগ বিভিন্ন স্তরে ভাগবাটোয়ারা হতো। এজন্য এসব বিষয় জানাজানির পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হতো না। স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই চকবাজার ও মিটফোর্ড এলাকায় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন মহিন ও অপু দাস। বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন ব্যবসায়ীরা। ফুটপাথ দখল করে দোকান থেকে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে হুমকি দিয়ে চাঁদা তোলা ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। যারাই চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন তাদেরই মারধর করা হতো এবং দোকান বন্ধ করে দেয়া হতো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, সোহাগকে হত্যার কয়েকদিন আগেও এক এম্বুলেন্স ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য সবার সামনে বেধড়ক মারধর করেন মহিন ও অপু দাস। 

থাকেনি সন্ত্রাসীরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর লাশের উপর তারা উল্লাস করতে থাকে। হত্যার পর তারা রাস্তার উপর অনেকক্ষণ লাশ ফেলে রাখে। ঘটনাস্থলে অনেক মানুষ থাকলেও আতঙ্কে ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। এখন বক্তব্য দিলে পরবর্তীতে তার ওপর হামলা হবে না এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে? নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, আমার ভাই ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বসবাস করে আসছে। ২০১৮ সাল থেকেই সে ভাঙ্গাড়ি ব্যবসা করে আসছে। তার দু’টি দোকান রয়েছে এর মধ্যে একটি দোকান গত তিন মাস আগে নিয়েছিল। আমার ভাইয়ের পরিচিত লোকজনই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তিনি বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে সমপৃক্ত ছিলেন। খুনিরা আমার ভাইয়ের কাছে ২ লাখ টাকা এবং ব্যবসার লাভের ৫০ শতাংশ দাবি করে। চাঁদা না দেয়ায় আমার ভাইকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমরা এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। 

হত্যা মামলায় মাহমুদুল হাসান মহিনকে পাঁচদিন এবং তারেক রহমান রবিনকে অস্ত্র মামলায় দু’দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

টিটন পাঁচদিনের রিমান্ডে: সোহাগকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার মো. টিটন গাজীর পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বিকালে শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিব উল্লাহ গিয়াসের আদালত এই আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আসামিকে আদালতে হাজির করে সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। এদিন আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। টিটনের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামি টিটন গাজী ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সে ঘটনায় জড়িত অন্যান্য আসামির পরিচিত। এজাহারনামীয় অন্যান্য আসামির পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা সংগ্রহসহ এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামিদের শনাক্তে তাকে রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। আসামিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে মামলার ঘটনার ধারাবাহিকতা, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হবে এবং ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র-সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এদিকে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে আসামি টিটন। শুনানিতে বিচারক আসামি টিটন গাজীকে জিজ্ঞাসা করেন আপনি কিছু বলতে চান কিনা? জবাবে তিনি বলেন- জি স্যার, আমার কোনো আইনজীবী নেই। আপনি (বিচারক) যে ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখেছেন, সেখানে আমাকে দেখা যাচ্ছে। আমি কাউকে আঘাত করিনি। আমাকে মোবাইলে ফোন করে ডাকা হয়েছিল। ফোন পেয়ে সেখানে যাই। আমি কাউকে আঘাত করিনি। ভিকটিমকে আঘাত করার জন্য হুকুমও দেইনি। আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি নির্দোষ স্যার। বিচারক শুনানি শেষে আসামির পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

চাঁদাবাজি নয় ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে খুন-ডিএমপি: গতকাল ডিএমপি’র মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে ভাঙাড়ি ব্যবসা এবং দোকানে কারা ব্যবসা করবে সেটা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগ এবং যারা হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে তারা একসঙ্গে কিছুদিন ব্যবসা করেছে। যখন ব্যবসা লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তখনই তারা বিবাদে লিপ্ত হয়। এর ফলে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। এ ঘটনায় পুলিশ অত্যন্ত তৎপর রয়েছে। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় মূল রহস্য উদ্‌ঘাটন, সংশ্লিষ্ট সব অপরাধী গ্রেপ্তার এবং সোহাগ কেন এই ঘটনার শিকার হলো তা উদ্‌ঘাটনের জন্য একটি চৌকস টিম গঠন করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) একেএম শহিদুর রহমান বলেন, ঘটনাটি স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। তবে এটার বিস্তারিত বলার মতো অবস্থায় আমরা নেই। আপাতত আমরা এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছি।