Image description

ফেনীর ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে ৭ হাজার মানুষ। ২৪-এর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার এক বছর না পেরোতেই জেলায় ফের বন্যা ও শহরে জলাবদ্ধতায় ক্ষোভ ও উদ্বেগ জানিয়েছে কয়েকটি নাগরিক ও সামাজিক সংগঠন।

বুধবার (৯ জুলাই) রাতে এ নিয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন নাগরিক সংগঠন ফেনী কমিউনিটির মুখপাত্র বুরহান উদ্দিন ফয়সল, ইউনিভার্সিটি এক্স স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ফেনী-উসাফের সভাপতি অধ্যাপক এবিএম নুরুল আবসার ও সেক্রেটারি ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন রাসেল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এক্স স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ফেনীর পক্ষে অধ্যাপক মোশাররফ হোসাইন, ফেনী সদর অ্যাসোসিয়েশন ঢাকার সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন, সেক্রেটারি নাসির উদ্দিন রুমেল, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি এক্স স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ফেনীর সাধারণ সম্পাদক শরিফুর রহমান আদিল, ফেনী জেলা ছাত্রকল্যাণ পরিষদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা এহসানুল মাহবুব জোবায়ের ও সভাপতি শরিফুল ইসলাম শ্রাবণ।

বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাতে ফেনী জেলা শহর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ ধরনের বৃষ্টি মৌসুমে স্বাভাবিক বিষয় হলেও নগর ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার চরম বেহাল দশা শহরবাসীকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছে। পথঘাট, বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ডুবে যাওয়ার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীদের চলাফেরা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও অফিস কার্যত অচল অবস্থায় রয়েছে। আমরা মনে করি, এ পরিস্থিতি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং বছরের পর বছর অপরিকল্পিত ড্রেনেজ, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব এবং দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর অবহেলার ফল।

তাদের অভিযোগ, এক বছর আগে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় আশপাশের অন্তত ১১ জেলার মানুষের হাজার কোটি টাকার সম্পদহানি হলেও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় অজানা কারণে অবহেলিত এ অঞ্চলের কল্যাণে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অজানা কারণে বিগত প্রায় দেড় যুগ ধরে বঞ্চনার শিকার ফেনীবাসীকে বন্যা থেকে স্থায়ী সুরক্ষা দিতে পানিসম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে বারবার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের পক্ষ থেকে তাগাদা দেয়া হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। যার ফলে এবারও ভারত থেকে আসা পানিতে পরশুরাম ফুলগাজীর মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

তারা মনে করেন, বিএসএফ কর্তৃক বল্লামুখা বাঁধ কেটে দেয়ার এক বছর পরও বাঁধটি পুনর্নির্মাণ করতে পারেনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ফলে বর্ষার এ সময়ে ভারতীয় পানিতে ডুবেছে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশিরা। পানিসম্পদ উপদেষ্টাও এর দায় এড়াতে পারেন না।

এ সময় তাঁরা ৭টি দাবি জানান। সেগুলো হলো-

১. অবিলম্বে বল্লামুখা বাঁধ পুনর্নির্মাণ করে স্থায়ী বন্যা প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে হবে। ২. মুছাপুর ক্লোজার পুনর্নির্মাণে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩. বাঁধ ও পানি নিষ্কাশন কার্যক্রমের দুর্নীতি তদন্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ৪. দ্রুততম সময়ের মধ্যে শহরের পানি নিষ্কাশনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৫. ড্রেনেজ সিস্টেম সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ৬. নগর উন্নয়নের নামে যত্রতত্র নির্মাণকাজ ও বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। ৭. জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রশাসনিক তদারকি জোরদার করতে হবে।

এদিকে স্থানীয় জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে,বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশে ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাদুর্গত ৬ হাজার ৮২৬ জন মানুষ অবস্থান করছেন। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ইতোমধ্যে ৯০ জন স্বেচ্ছাসেবক মাঠে কাজ করছে।

অপরদিকে আমাদের ছাগলনাইয়া প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর কবির লিটন জানান, মুহুরী নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে আশপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। এবারও উপজেলার মাটিয়াগোধা, দক্ষিণ সতর নদীরকূল, দক্ষিণ সতর, উত্তর পানুয়া, কাশিপুর, নিচিন্তা, লক্ষ্মীপুরসহ ১০টিরও বেশি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।

একই উপজেলার বাসিন্দা শেখ কামাল বলেন, পরশুরাম-ফুলগাজীর ভাঙন স্থান দিয়ে আসা পানিতে ছাগলনাইয়া উপজেলা প্লাবিত হচ্ছে। সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে গিয়ে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পানির চাপ বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে পানিগুলো ফেনী সদর উপজেলাতেও প্রবেশ করার শঙ্কা রয়েছে।

ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবল চাকমা বলেন, মাঠপর্যায়ে থেকে দুর্গত মানুষের সহায়তায় আমরা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছি। উপজেলায় ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ছাগলনাইয়ার বিভিন্ন এলাকায় তীব্র স্রোতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

ফুলগাজীর ঘনিয়ামোড়া এলাকার বাসিন্দা কবির আহম্মেদ নাসির বলেন, নদীতে পানি কমলেও ভাঙন স্থান দিয়ে তীব্র স্রোতে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। গলা সমান পানিতে বের হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় আরও বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে।

ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, জেলায় টানা তিন দিন ধরে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। বুধবার (৯ জুলাই) রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারও জেলাজুড়ে হালকা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, রাত ১১টার দিকে নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পানি কমলেও ভাঙন স্থান দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানি কমার পরেই বাঁধ মেরামতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশে অন্তত ২০ হাজার মানুষ দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭ হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলার ছয় উপজেলায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।