
রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া গত মঙ্গলবার বিএনপির কাছে পাঠানো হয়েছে। জানা গেছে, গত দুই দিন দলটির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই খসড়া ঘোষণাপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে কিছুটা সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত করা হয়। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে দলের মতামত সংবলিত কপি সরকারকে পৌঁছে দিবে বিএনপি। সরকারের তরফে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার দায়িত্বে আছেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপির নেতারা ছাত্রদের দাবির সাথে একমত পোষণ করে দ্রুত জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তারা সরকারের দেয়া খসড়া আন্তরিকতার সাথে মূল্যায়ন করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। এ ঘোষণাপত্র নিয়ে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি কেন সামনে আনা হলো, এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং তখন এ উদ্যোগের সাথে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে উল্লেখ করেছিল। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়।
এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো তখন ওই খসড়ার ওপর তাদের মতামত দেয়। পরবর্তীতে ছাত্রদের দেয়া সময়সীমা শেষ হওয়ার পর দিন গত ১৬ জানুয়ারি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সাথে মতবিনিময় করেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই ইস্যুতে সরকারের কার্যক্রম ধীর গতিতে চলতে থাকে। একপর্যায়ে এই দাবিতে গত ৩০ জুন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন জুলাই আন্দোলনে আহতরা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সম্প্রতি সরকারকে আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় তাদের পক্ষ থেকে ওই দিনই ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গণতন্ত্রে উত্তরণের পাশাপাশি জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রামের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন, এই ভূখণ্ডের মানুষের ওপর দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তান শাসকদের বঞ্ছনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালে লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। এর পরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ২০২৪ সালে কীভাবে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান, সে প্রসঙ্গও রয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায়। এ ছাড়া খসড়ায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করা হয়েছে। জানা গেছে, আগের ওই খসড়ার সাথে নতুন করে আরো বেশ কিছু ইস্যু যুক্ত করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করা হয়েছে-
যেহেতু বর্তমান বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের এ ভূখণ্ডের মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রাম করেছিল এবং এর ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সাল থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।
যেহেতু এই ভূখণ্ডের মানুষ তাদের ওপর দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তান শাসকদের বঞ্ছনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।
যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের কিছু কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার জনআকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকারিতা ক্ষুণœ করেছিল।
যেহেতু এই স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে মত প্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করার ফলে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মত প্রকাশ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃ প্রবর্তনের পথ সুগম হয়।
যেহেতু ৮০ দশকের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনতার অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার পথ সৃষ্টি হয়।
যেহেতু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শাসনামলের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনির্মাণের ব্যর্থতা ও অপর্যাপ্ত ছিল এবং এ কারণে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
যেহেতু ক্ষমতার সুষ্ঠু রদবদলের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুযোগে ষড়যন্ত্রমূলক ১/১১-এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র আধিপত্যের পথ সুগম হয়। শেখ হাসিনার শাসনামলের গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, দলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে। বিগত সরকারের আমলে গণবিরোধী একনায়কতান্ত্রিক, মানবাধিকার হরণকারী শক্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুনি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পরিচিত করে।
যেহেতু শেখ হাসিনার পরিবারের নেতৃত্বে উন্নয়নের নামে দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও বিদেশে টাকা পাচার সব সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে। এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র, শ্রমিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ গত ১৫ বছর নিরন্তর সংগ্রাম করে জেল-জুলুম, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয় এবং বিদেশী রাষ্ট্রের তল্পিবাহক আওয়ামী লীগ ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করে।
যেহেতু বিগত গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার এবং প্রতিনিধিত্ব বঞ্চিত করে ছাত্র ও তরুণদের নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়। সরকারি চাকরিতে একচেটিয়া দলীয় ও কোটাভিত্তিক নিয়োগ চরম বৈষম্য তৈরি করা হয়।
যেহেতু, আওয়ামী লীগের দমন এবং গণহত্যার পরও দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতা গণবিক্ষোভকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেন। অভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রদের ৯ দফা দমনে সরকার নির্মমতা চালায়। ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি করে ব্লক রেইডের মাধ্যমে আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
যেহেতু ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, শ্রমিক প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। এক পর্যায়ে জনগণের লড়াইয়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও সমর্থন দেন। ফ্যাসিবাদ বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে জনগণ ঢাকামুখী লংমার্চ করলে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যায়।
যেহেতু ৬ আগস্ট ২০২৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয় এবং তাদের অভিপ্রায় অনুসারে জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা ও অর্থনীতি সচল রাখা এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্যক্রমের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বলে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের মতামত অনুসারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার অনুমোদিত হয়।
সেহেতু ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিদ্যমান সংস্কার উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় সংশোধন, পুনর্লিখন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।
এর বাইরেও আরো কিছু ইস্যু খসড়া ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। জানা গেছে, বিএনপি সংবিধান বাতিল না করে সংশোধনের পক্ষে মতামত দিয়েছে।
নারীদের আসন ১০০তে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত : গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপ, নারী আসন, নির্বাচনের পিআর পদ্ধতিসহ সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ মার্কিন শুল্ক আরোপের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। একই সাথে এই শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার জন্য আমেরিকা সরকারের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
জানা গেছে, বৈঠকে সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের রিপোর্ট তুলে ধরেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। এর পর সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে মতামত দেন বিএনপি নেতারা। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে ইতোমধ্যে সংসদে নারীদের আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে। তবে তারা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সে ব্যাপারে এখনো ঐকমত্য হয়নি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, তারা প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করার পক্ষে অবস্থান নিবে। পাশাপাশি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেও নয় তারা।
বৈঠকে স্থায়ী কমিটির দুইজন সদস্য বলেন, ঐকমত্য কমিশনে সংস্কারের অনেক বিষয়ে ইতোমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সরকার সেগুলো কেন বাস্তবায়ন করছে না। সরকারের উচিত অবিলম্বে এটা বাস্তবায়ন করা।