
আরও একবার বুঝি উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়েই চাপানো হলো। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পুরোনো সমস্যাতে ভুগেই বাংলাদেশ সিরিজ হারল। সিরিজ শেষে অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ এসে জানালেন, দল নাকি এখনও তরুণ, তাই এই দলের আরও সময় দরকার।
ম্যাচ শেষে পুরষ্কার বিতরণীতে তিনি বললেন, ‘আমাদের দল এখনো তরুণ, কিছু খেলোয়াড় নতুন এসেছে। অবশ্যই আমরা সবসময় ইতিবাচক জিনিসটা ভাবি। আমাদের সময় দরকার। যদি তাদের সুযোগ দেন, একদিন হয়তো তারা ভালো খেলবে।’
বাংলাদেশের স্কোয়াডের দিকে নজর রাখা যাক। শ্রীলঙ্কা সিরিজে বাংলাদেশ দুজনকে অভিষেক করিয়েছে– পারভেজ হোসেন ইমন আর তানভীর ইসলাম। দ্বিতীয় ওয়ানডে যে বাংলাদেশ জিতেছে, সেটায় এই দুজনের অবদান ছিল বেশ। দুজনের ওই দুই পারফর্ম্যান্স বাদ দিলে তো সিরিজে হোয়াইটওয়াশই হতে হতো বাংলাদেশকে!
অধিনায়ক মিরাজের ‘এখনো তরুণ’ আখ্যাটা যে মোটেও যুতসই নয়, সেটা স্কোয়াডের অভিজ্ঞতার দিকে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তাসকিন আহমেদের ৩টি ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা আছে, দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ তিনিই। মোস্তাফিজুর রহমানেরও ২টি বিশ্বকাপ খেলা হয়ে গেছে। মিরাজের নিজেরই ২টি করে বিশ্বকাপ আর এশিয়া কাপ খেলার অভিজ্ঞতা আছে ঝুলিতে। নাজমুল হোসেন শান্ত, তাওহীদ হৃদয়ও খেলেছেন ১টা বিশ্বকাপ। এই স্কোয়াডের অভিষিক্ত দুই খেলোয়াড় বাদে সবচেয়ে তরুণ ক্রিকেটারেরও ভিন্ন ফরম্যাটে অন্তত একটি আইসিসি টুর্নামেন্ট খেলার অভিজ্ঞতা আছে।
দলের প্রায় সবাই তরুণ, কথাটা ঠিক, বয়সের দিক থেকে সবাই ঠিক তাই। কিন্তু এতটা বছর ক্রিকেট খেলে এখন আবার নতুন করে সময় প্রয়োজন কেন? এই যুক্তি দিয়ে কি আবারও সেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকারই চেষ্টা হচ্ছে না?
যা ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেই ‘মাছ’টা কী? সেটা হচ্ছে দলের মিডল অর্ডার। বোলিং, ফিল্ডিং বা টপ অর্ডার, তাও এসব বিভাগ পাস মার্ক পেয়ে উতরে যেতে পারে। কিন্তু মিডল অর্ডারের যে যাচ্ছেতাই দশা, সেটা কোনোভাবেই পাস নম্বর পেতে পারে না। শেষ অনেক দিন ধরেই ডাহা ফেল বাংলাদেশের মিডল অর্ডার।
গেল বছর আফগানিস্তান সিরিজে মোহাম্মদ গজানফরের সামনে প্রথম ওয়ানডেতে ওভাবে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার কথা মনে আছে? সেদিনের হারের দায়টাও বর্তায় এই মিডল অর্ডারের ওপরই। সে ম্যাচে বাংলাদেশের স্কোরকার্ড ১২০/২ থেকে ১৪৩/১০ হয়ে যায় চোখের পলকেই। শ্রীলঙ্কা সফরের প্রথম ম্যাচেও প্রায় একই রকমের ধস দেখা গেছে।
এর মাঝে ওয়ানডে যা খেলেছে বাংলাদেশ, তাতেও সফলতার মুখ খুব একটা দেখেনি দলের মিডল অর্ডার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে রান এসেছে বটে, কিন্তু নিখাদ ব্যাটিং উইকেটে দলের ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এরপর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আসতেই আবারও পুরোনো রূপ ফেরে, ভারত ম্যাচে মিডল অর্ডার থেকে সেঞ্চুরি করেছিলেন তাওহীদ, কিন্তু তার পাশের বাকিরা ফিরেছেন এক অঙ্কে। নিউজিল্যান্ড ম্যাচেও ৪ থেকে ৬ নম্বরের ব্যাটাররা রান পাননি। তাই ৯৭/২ থেকে মুহূর্তেই ১১৮/৫ হয়ে গেছে দলের স্কোরবোর্ডের চেহারা।
ওয়ানডে ক্রিকেটে মিডল অর্ডারে এমন ধস তাই নতুন কিছু নয় আদৌ। সেটা আবার অনভিজ্ঞতার কারণে নয়, অভিজ্ঞদের নিয়েই এভাবে ভরাডুবি হয়েছে নিয়মিত। শ্রীলঙ্কা সিরিজে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের মতো অভিজ্ঞরা নেই বটে, যারা আছে তারাও কম অভিজ্ঞ নন, কিন্তু তাদের দিয়েও পারফর্ম্যান্সটা হয়েছে দেশের ক্রিকেটের প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতোই।
সে যুগে দ্রুত কিছু উইকেট খোয়ানোর পর লোয়ার মিডল অর্ডারের ব্যাটার টেল এন্ডারদের সঙ্গে নিয়ে ‘মুখ রক্ষার’ স্কোর দাঁড় করাতেন। এখনও তাই হচ্ছে। দ্রুত উইকেট চলে যাচ্ছে মিডল অর্ডারে, এরপর জাকের আলী, তানজিম সাকিবরা মিলে কিছু একটা স্কোর দাঁড় করাচ্ছেন দলের স্কোরবোর্ডে।
মিডল অর্ডার থেকে রান আসছে না, বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে গেছে রীতিমতো। সেটা সামলাতে বাংলাদেশ ম্যানেজমেন্ট এই সিরিজে কী উদ্যোগ নিল? স্কোয়াড থেকেই দেখে আসা যাক নাহয়। বাংলাদেশের স্কোয়াডে স্বীকৃত ব্যাটার, যারা শুধু এক পরিচয়েই খেলবেন, এমন ক্রিকেটার ছিলেন ৭ জন। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এই তালিকার ৫ জনই ওপেনার, তানজিদ হাসান তামিম, লিটন দাস, পারভেজ হোসেন ইমন, মোহাম্মদ নাঈম নিয়মিত ওপেনার; নাজমুল হোসেন শান্তও ওপেনার হিসেবে খেলেছেন অনেক ম্যাচে। তালিকার মোটে ২ জন ব্যাটার আছেন মিডল অর্ডার স্পেশালিস্ট– তাওহীদ হৃদয় আর জাকের আলী।
বাংলাদেশ এই তিন ম্যাচে মিডল অর্ডারে বা ৪ থেকে ৬ নম্বর পজিশনে খেলিয়েছে যথাক্রমে লিটন দাস, তাওহীদ হৃদয়, মেহেদী হাসান মিরাজ আর শামীম পাটোয়ারীকে। এই পজিশনে জোড়াতালি দিয়েই প্রতিদিন একাদশ সাজিয়েছে বাংলাদেশ। নিয়মিত নতুন বল সামলানো লিটন তার নতুন ভূমিকায় মানিয়ে নিতে পারেননি। তার জায়গায় দ্বিতীয় ম্যাচ থেকে সুযোগ পেয়ে ‘ফিনিশার’ শামীমও ব্যর্থ একেবারেই।
মিডল অর্ডার থেকে দুই ম্যাচে ফিফটি করেছেন তাওহীদ হৃদয়। তবে তার স্ট্রাইক রেট ছিল দৃষ্টিকটুভাবে কম, ৬৮.২১। মিডল অর্ডার থেকে রান আসছে না, আর যখন আসছে, সেটা আসছে অনেক ধীরগতিতে। শেষ অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের সমস্যার কারণ লুকিয়ে এখানেই। মিডল অর্ডারে এক শামীম বাদে অভিজ্ঞতার ঝুলিটা বেশ ভারী বাকি সবারই। তাই ‘তরুণ’ বলে এই ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
অধিনায়ক যখন ‘তরুণ দলের’ জন্য সময় চান, তখন আরও একটা বার্তা চলে আসে; তার মানে দাঁড়ায় প্রক্রিয়াটা ঠিকই আছে, শুধু একটু ধাতস্থ হতে সময় লাগবে এই যা! কিন্তু বাস্তবতা কি তা বলে? জোড়াতালি দিয়ে মিডল অর্ডার সমস্যার সমাধান খোঁজা হয় যখন, তখন আর যাই হোক প্রক্রিয়া ঠিক থাকে না। এই প্রক্রিয়ায় যত বেশি সময় দেওয়া হবে, দলের পারফর্ম্যান্স পেছনের পায়ে হাঁটবে ততই। বিষয়টা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে নির্বাচক প্যানেল আর ম্যানেজমেন্ট, ততই মঙ্গল।