Image description

দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ যখন ছড়িয়ে পড়েছে জেলা থেকে জেলা, তখন সেই আন্দোলনের আগুনে ঝরে পড়েছিল শেরপুরের শ্রীবরদীর এক দরিদ্র পরিবারের ভরসার নাম—সবুজ। গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ হয়ে সে ফিরেছিল বাড়ি, যেখানে তার জন্য রান্না করে অপেক্ষায় ছিলেন মা।

শ্রীবরদী উপজেলার রুপারপাড়া গ্রামের প্যারালাইজড রোগী আজাহার আলী ও গৃহিণী সমেজা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান সবুজ ছিলেন পরিবারের মূল ভরসা। দুই ভাই ও দুই বোনের এই পরিবারে বড় বোনের বিয়ের পর দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন সবুজ। স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে পার্টটাইম কাজ করে পরিবার চালাতেন, সেই সঙ্গে চালিয়ে যেতেন নিজের পড়াশোনাও।

২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে অংশ নিয়েছিলেন শ্রীবরদী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সবুজ। তবে পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই ৪ আগস্ট জেলা শহরের খরমপুর মোড়ে আন্দোলনের মিছিলে দুর্বৃত্তদের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। পরে ১৫ অক্টোবর ফল প্রকাশ হলে দেখা যায়, সবুজ পেয়েছেন ৪.৩৩ জিপিএ। এই ফলাফল শোনার পর পরিবার আরও ভেঙে পড়ে।

সবুজের মা সমেজা খাতুন ডুকরে কেঁদে বলেন, ‘শহীদ আবু সাঈদের বেশ ধরে আন্দোলনে গেছিল আমার ছেলে। বলছিল, দেশে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। এই সরকারকে সরাইতে হইব, নাহলে চাকরি হইব না। সকালে বলে, ‘আম্মা ভাত রান্না করো, ফিরে এসে খাব।’ আর ফিরলো না...’

বাবা আজাহার আলী বলেন, ‘আমার শরীর প্যারালাইজড, সংসার চলতো আমার পোলাডার টাকায়। রেজাল্ট দেয়ার পরে জানলাম কত ভালো ফল করছে। এখনো যারা আমার ছেলেকে মেরেছে তারা ঘুরে বেড়ায়। এই কি বিচার?’

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন, শ্রীবরদী সরকারি কলেজ, বিএনপি, জামায়াত, বন্ধু এবং কলেজের বড় ভাইরা এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন বলেও জানান পরিবার।

একজন দরিদ্র পরিবারের ভরসা, এক মেধাবী ছাত্র, এক সচেতন তরুণকে হারিয়ে শুধু একটি পরিবার নয়, ব্যথিত হয়েছে পুরো সমাজ। সবুজের মৃত্যু প্রমাণ করে—এই আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন কেবল রাজনৈতিক কর্মী নয়, তার চেয়েও বড় কিছু—স্বপ্ন দেখানো সাধারণ মানুষ। তার মা-বাবার এখন একটাই দাবি—এই নির্মম হত্যার যেন বিচার হয়, শহীদের রক্ত যেন ন্যায়ের পথে বিফলে না যায়।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।