
খুলনার প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির দখল পাল্টা দখল নিয়ে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্নে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও সরকারপন্থিরা ছিলেন ১৮ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ছয়জন আত্মগোপনে চলে যান এবং অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। গতিশীলতা ফেরাতে বিএনপি নেতাদের পরামর্শে নিয়োগ দেওয়া হয় নতুন ট্রাস্টি সদস্য। পরে তারাই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের পদে বসেন।
ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া অনিয়ম, দুর্নীতি ও জঞ্জাল সাফ করার পরিবর্তে নতুন বোর্ডের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিবিধ খাতে ভুয়া বিল ভাউচারে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় বিরোধ তীব্র হয় দুই পক্ষের। এদিকে প্রশাসনের টানাপড়েনে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কমে গেছে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর অনুমোদনের পরের বছর শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। শুরুতে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেসিসির সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। হাসিনার পতনের পর খালেকসহ ছয় ট্রাস্টি আত্মগোপনে চলে যান। বোর্ডের চেয়ারম্যান হন বিএনপি সমর্থিত ট্রাস্টি সিরাজুল হক চৌধুরী। চেয়ারম্যান হওয়ার পর বোর্ডে নিজের লোক বাড়াতে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর মিজানুর রহমানকে ও চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি আজিজুল হক ও সৈয়দ হাফিজুর রহমানকে ট্রাস্টি বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করেন। নিয়ম অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হতে যৌথ মূলধনী কোম্পানি থেকে নিবন্ধন প্রয়োজন হয়। কিন্তু নতুন তিনজনের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
চেয়ারম্যান সিরাজুল হক দেশে না থাকার সুযোগে গত ২১ মে ট্রাস্টি বোর্ডের সভা ডেকে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন মিজানুর রহমান। সৈয়দ হাফিজুর রহমানকে করা হয় সদস্য সচিব। গত ১৯ জুন পরিকল্পিত মব তৈরি করে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারকে অবরুদ্ধ করে রাখেন শিক্ষার্থীদের একাংশ। চারঘণ্টা পর সেনা সদস্যরা তাকে উদ্ধার করেন।
এ ঘটনায় ২৫ জুন সোনাডাঙ্গা থানায় করা জিডিতে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সাহিদা খানম উল্লেখ করেন, মিজানুর রহমান ও হাফিজুর রহমান নিজেদের চেয়ারম্যান-সদস্য সচিব ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় দখলে রেখেছেন। চাপ দিয়ে বিজ্ঞাপন, ভর্তি-সংক্রান্ত মার্কেটিংয়ের কাজসহ বিভিন্ন সভার নামে লাখ লাখ টাকা তছরুপ করছেন। প্রক্টর শাকিল আহমেদ ও পরিচালক লিয়াজোঁ শেখ মারুফুর রহমানের উস্কানিতে কতিপয় শিক্ষার্থী আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন।
এ ঘটনার দুদিন পর উপাচার্য অধ্যাপক সেখ মো. এনায়েতুল বাবরও শিক্ষার্থীদের মবের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন। অভিযোগ রয়েছে, মহানগর বিএনপির এক শীর্ষ নেতার ইন্ধনে অন্য ট্রাস্টিদের পক্ষে টানতে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন মিজানুর রহমান। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি ট্রাস্টি সদস্য তৌহিদুল ইসলাম আজাদ, সৈয়দ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ ও পবিত্র কুমার সরকারকে আসামি করা হয়েছে বিএনপির সমাবেশে হামলার এক রাজনৈতিক মামলায়।
পরিস্থিতি সম্পর্কে সিরাজুল হক চৌধুরী বলেন, নতুন ক্যাম্পাসে বিল্ডিংয়ের ডিজাইনের জন্য একটি আর্কিটেকচার ফার্মকে এক কোটি টাকা বিল দিতে হবে বলে দাবি করেন মিজান। টাকার অংক অস্বাভাবিক বলে আমি আপত্তি করায় বিরোধ শুরু হয়। এছাড়া হাইকোর্টের মামলা খাতে, জমির পিট দলিল তোলার নামে, পহেলা বৈশাখ উদযাপনে, কারণে অকারণে আপ্যায়নে, বোর্ড মিটিংয়ের নামে লাখ লাখ টাকার ভুয়া ভাউচার করতে থাকে। যারা এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করেছে তাদের সবাইকে দোসর আখ্যা দিয়ে পরিকল্পিত মব সৃষ্টি করে হটানো হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ২০ জনকে নিয়োগ দিয়েছে তারা। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মদতে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল হচ্ছে, বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেও প্রতিকার পাচ্ছি না।
তবে মিজানুর রহমান বলেন, ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বেশিরভাগ সদস্য ফ্যাসিস্টের দোসর। আমি নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলায় তাদের চুরি ধরা পড়ে যাবে বলে ভয়ে মিথ্যা অভিযোগ আনছে। নতুন বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করার জন্য আট ডিপার্টমেন্ট থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন, ইউজিসি আমাদের ট্রাস্টি হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। যৌথ মূলধনী কোম্পানিতে অডিট রিপোর্ট জমা দিলে নিবন্ধন হয়ে যাবে।
এক ট্রাস্টি বোর্ডে দুজন চেয়ারম্যান দাবি করায় ইউজিসির সিদ্ধান্ত জানতে চিঠি দিয়েছেন ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য কানাই লাল সরকার। ইউজিসি এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। তিনি বলেন, মিজান সাহেব ক্যাম্পাসে আসেন, নিয়ম অনুযায়ী সহযোগিতা করছেন। কিন্তু অন্যজনকে খুলনাতেই পাওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতির কারণে এবার ছাত্র ভর্তি কম হয়েছে স্বীকার করলেও তাতে সমস্যা হবে না দাবি তার।