
ড. মাহফুজ পারভেজ
বিএনপি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন করেছেন বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসাবে সাধারণভাবে পরিচিত অর্থনীতিবিদ ও লেখক ড. মাহবুব উল্লাহ্। ড. মাহবুব উল্লাহ্ সত্যভাষণে ও স্পষ্টবচনে সিদ্ধ। এজন্য পক্ষ ও প্রতিপক্ষের কাছে তিনি আক্রান্তও হয়েছেন একাধিক বার। তারপরেও তিনি নিজের বিবেচনা ও উপলব্ধি প্রকাশে কুণ্ঠিত হন নি। তার মতামতের সঙ্গে বাস্তবতার মিল রয়েছে যথেষ্টই। তার বক্তব্য ও নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, কথাগুলো পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হলে বিএনপিই লাভবান হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ্ ০৫ জুলাই সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘আপনি বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত দল বলছেন; তবে আমি তেমনটা মনে করি না।‘ তিনি বলেন, ‘তবে আপনারা যেমনটা মনে করেন, বিএনপি সেভাবে সংগঠিত বলে আমি মনে করি না। তার একটা বড় দুর্বলতা হলো, নাগরিক সমাজের মধ্যে তার অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। ক’জন লেখক, ক’জন নামকরা সাংবাদিক, ক’জন কবি, ক’জন বিজ্ঞানী, ক’জন ইতিহাসবিদ বা সমাজতত্ত্ববিদ তাদের দলের সঙ্গে আছে? তুলনামূলক আওয়ামী লীগের তা অনেক বেশি ছিল। তবে বুদ্ধিবৃত্তির জগতের সেই লোকেরা সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেনি বলেই আওয়ামী লীগের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। বুদ্ধিজীবীর স্বাধীন ভূমিকা তারা রাখতে পারেনি।‘
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ড. মাহবুব উল্লাহ্ বলেন, ‘আমি বহু বছর বিএনপিকে কাছ থেকে দেখছি। দলটির কর্মীরা এমনকি রাজনৈতিক শিক্ষাও যথাযথভাবে পায়নি। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সেমিনার, কর্মশালা হচ্ছে ঠিক। কিন্তু এগুলো ধারাবাহিকভাবে না হলে স্তরে স্তরে দলীয় আদর্শ ভালোভাবে ছড়ায় না। আর এগুলোর মালমসলা আসে প্রধানত লেখালেখি, বইপত্র ইত্যাদি থেকে, যা করার কথা বুদ্ধিজীবীদের। সেটাও তেমন দেখা যায় না
তিনি আরো বলেন, ‘প্রধানত আবেগের বশে কর্মীরা দলে আছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি তাদের ভালোবাসা অনেক। এ ধরনের নেতাকর্মী দিয়ে রাজনৈতিক গতিবিধি প্রভাবিত করা যায় না। দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রচুর অপকর্মের অভিযোগ আসছে। ফলে আওয়ামী লীগ চলে যাওয়ার পর বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষ যেভাবে ভরসা করতে পারত, তা হচ্ছে না। আমি নিজেও উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতিতে
তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, আপনি কি মনে করেন না, বিএনপি সরকারকে ঠিক ধারায় রাখার জন্য কাজ করছে, তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি নেতারা এতদিন যা করেছে, তা নিয়েও আমার কথা আছে। তারা এ সরকারের বিরুদ্ধে এতদিন যে ভাষায় কথা বলেছে, তা মাঝে মাঝে অসৌজন্যমূলক পর্যায়েও চলে যেত। এগুলো কিন্তু তাদের কোনো লাভ বা ডিভিডেন্ড দেয়নি। তারা যদি ঠান্ডা মাথায় সরকারের কাছে তাদের কথাগুলো পেশ করত তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। সেগুলো হৃদয়গ্রাহী হতো, জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতো। সম্ভবত এসব দেখেই খালেদা জিয়া একলাইনে একটা মন্তব্য করলেন, এ সরকারের বিরোধিতা করে আমাদের কী লাভ? এর পরই আমরা পরিস্থিতি পাল্টাতে দেখলাম। বিএনপি কিছুটা সংযত আচরণ করছে– কথাবার্তা ও উচ্চারণে।‘
ড. মাহবুব উল্লাহ্র বক্তব্যে জনমত গঠনে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গ এসেছে, যা খুবই সত্য। বিএনপি যে রাষ্ট্র সংস্কারের নানা দফা কর্মসূচি দিয়েছে, তাতে কয়জন বুদ্ধিজীবী পত্রিকায় কলাম লিখে জনমত গঠন করেছেন? কয়জন সভা-সমিতি-সেমিনারে অংশ নিয়ে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। কিন্তু তারপরেও সরকার বদলের পর পরই দেখা গেলো বিএনপির নাম ভাঙিয়ে শতাধিক সুবিধাবাদী মানুষ প্রশাসন, উচ্চশিক্ষাঙ্গনসহ নানা প্রতিষ্ঠানের পদ-পদবী বাড়িয়ে বসে গেছেন। তারা এখন দলের সঙ্গে আদৌ যোগাযোগ রাখে কিনা সন্দেহ। বরং নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস শুরু হলে তারা কোন দিকে পাড়ি দেবেন, সেটাও বলা মুস্কিল।
বিএনপি সব সময়ই নানা ইস্যুতে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে ব্যবহার করেছে। কিন্তু তাদেরকে দলীয় মতাদর্শ বিকাশে কাজে লাগায় নি। দলের একটি পেশাজীবী শাখার মতো অনুগত বাহিনী আকারে রেখে দিয়েছে। গুলশানে একবার নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে মতবিনিময়ের জন্য বিএনপি বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণ জানায়। বেগম জিয়ার উপস্থিতিতে সেখানে বন্দনা, তেলবাজি, আত্মপ্রচার ও বিষোদাগার শুরু হয়। সেখানে যিনি সবচেয়ে বেশি গলাবাজি করেছিলেন তিনি এখন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য। হট্টগোলের এক পর্যায়ে প্রফেসর এমাজউদ্দিন, প্রফেসর তালুকদার মনিরুজ্জামান প্রমুখ কথা বলতে না পারায় প্রস্থান করেন। আমরা তাদের অনুগমন করি।
দলের সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আওয়ামী লীগ বিদায়ের পর বিএনপি সেজে শূন্যস্থান পূরণ করা হয়। বাস, টেম্পু, হাট, বাজার, ইজারাদারি থেকে সব কিছু দখল করা হয় বিএনপির নামে। যেসব অফিস ও অস্থায়ী ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের পোস্টার, ব্যানার ছিল, সেগুলো বদলে বিএনপির করে দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামে এ রকম একটি অফিস দখল করা হয় যে নেতার ছবি টাঙিয়ে তাকে আমি নিজে প্রশ্ন করেছিলাম, উমুক জায়গায় আপনার নামে অফিস চলছে। বিস্মিত হয়ে তিনি তাদের কাউকে চেনেনা বলে জানান। পরদিন সেগুলো সাফ করেন। কিন্তু এমন আরো অনেক অফিস অনেক জায়গায় বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চলছে।
সরকার বদলের পর সিলেটে গিয়ে জেনেছি, বালু, পাথরের ব্যবসাসহ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি হাত বদল হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে চলে এসেছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে আওয়ামী আমলে ব্যাংক ও শিল্প লুটপাটের জন্য দায়ী এক ব্যবসায়ীর স্বার্থ ও সম্পত্তি পাহাড়া দিচ্ছে যারা, তাদের সঙ্গেও বিএনপির নাম জড়িত।
এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে বটে। দলের ছত্রছায়ায় বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ কর্মী-সমর্থক পর্যন্ত পদ-পদবী ও আর্থিক স্বার্থের জন্য ম্যারাথন দৌড় শুরু করলে তাদের থামাবে কে? বিশেষত দল যখন ক্ষমতায় আসেনি, তখনই এমন ক্ষমতালিপ্সু হলে তো বিরাট বিপদ হবে। ক্ষমতায় গেলে এদের সামলানো সম্ভব হবে না।
ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতি ও দলীয় অবস্থানের নিরিখে বাংলাদেশ বর্তমানে এক গভীর সংকটে আছে। এটা স্বীকার করে ড. মাহবুব উল্লা্হ বলেছেন, ‘এ সংকট শুধু গণতন্ত্রের নয়; স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বেরও সংকট। এ থেকে উদ্ধারের জন্য প্রকৃষ্ট মাঝিমাল্লা দরকার। আমরা সেই মাঝিমাল্লার অপেক্ষায় আছি।‘ আমাদের জানা নেই, যারা বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দোলাচলের মধ্যে পদ বাগানো বা টাকা কামানোর তালে আছে, তারা ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের‘ সংকটের ব্যাপ্তি ও গভীরতা অনুধাবনে সক্ষম কিনা! একইভাবে, যারা দলীয় পদ ও পরিচিতি ব্যবহার করে নানাভাবে সংকট বাড়িয়ে নেতৃত্ব ও সংগঠনের বারোটা বাজাচ্ছেন, তারা শুধু দল নয়, দেশেরও বিপদ ডেকে আনছেন।
প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ, চেয়ারম্যান রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়