
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডান হাত হিসেবে পরিচিত পাঁচ মাফিয়া পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে মনিরুল ইসলাম ছিলেন দ্বিতীয়। এই মাফিয়া মনিরুলের দাপট এখনো চলছে পুলিশ প্রশাসনে।
সাবেক পাঁচ মাফিয়া পুলিশ কর্মকর্তার চক্রই সব অপকর্ম চালিয়ে গেছে। মনিরুল ছাড়াও চক্রের অন্যরা হলেন- সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ ও ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। মনিরুল ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান এবং প্রলয় কুমার জোর্য়াদার উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি)। শেখ হাসিনার গুম-খুনের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী এই চক্রের অন্যতম সদস্য ছিলেন কয়েকজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ডজনখানেক ডিআইজিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তা। পুলিশের সৎ, যোগ্য কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি পান ফ্যাসিস্টের সুবিধাভোগী এসব কর্মকর্তা। ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত জুলাই বিপ্লবের পরও এদের অনেকেই এখনো বহাল তবিয়তে। সেই সঙ্গে এখনো প্রভাব রেখে চলেছেন তারা। এ নিয়ে অসন্তোষ দানা বাঁধছে বাহিনীতে। পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সূত্রগুলো এসব বিষয় নিশ্চিত করেছে।
ফ্যাসিবাদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করা কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের শ্যালক অতিরিক্ত আইজিপি তৌফিক মাহবুব চৌধুরী। শেখ হাসিনার শাসনামলে তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ডিআইজি হিসেবে (প্রশাসন, লজিস্টিকস, এইচআর) গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেন। যদিও দলীয় সর্বোচ্চ আনুগত্য ছাড়া সাধারণত সদর দপ্তরে প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয় না। এর আগে বরিশালের এসপি হিসেবে বিএনপি-জামায়াত দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মাহবুব। ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), বিশেষ পুলিশ সুপার (প্রশাসন), রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ডিসি (সদর দপ্তর) পদে।
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মাহবুবকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত ব্যুরোতে (পিবিআই) বদলি করা হলেও তিনি পুলিশ সদর দপ্তর ছেড়ে যাননি। সাবেক আইজিপির ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও মাহবুব এখনো কীভাবে এত ক্ষমতাধর, বিষয়টি পুলিশ বাহিনীতে রীতিমতো একটা চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পুলিশ সদর দপ্তরে ডেভেলপমেন্ট শাখায় বহাল তবিয়তে রয়েছেন এই কর্মকর্তা। হাসিনার এসবি প্রধান মনির, প্রলয়, আতিক, হাসানুল হায়দারদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৫তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা ব্যাচের অনেক পেছনের দিকে সিরিয়াল হওয়ার পরেও অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পান। শুধু তা-ই নয়, ১২তম বিসিএস কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে তাকে পদোন্নতি দেয় ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকার।
১৫তম ব্যাচের মাসুদুর রহমান ভূইয়াকেও আওয়ামী লীগের সময় নিজের ব্যাচের কয়েকজনসহ ১২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে অতিরিক্ত আইজিপি করা হয়। শেখ হাসিনার সময় খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ছিলেন তিনি। সে সময় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর ক্র্যাকডাউনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে মাসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে। গোপালগঞ্জের এসপি থাকাকালীন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের আস্থা অর্জন করেন তিনি। ছিলেন হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি রাজশাহী রেঞ্জ। পদোন্নতি পেয়েছেন নিয়মিত। বর্তমানে সারদা পুলিশ একাডেমিতে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। এর আগে তিনি সর্বশেষ পুলিশ সদর দপ্তরে ছিলেন।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার আগে এসবি, এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের প্রতিবেদনে মাসুদুরকে আওয়ামী লীগের মতাদর্শের লোক বলে উল্লেখ করা হয়। তার বাবা জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগ করতেন এবং তার দুই ভাই আওয়ামী লীগ করেন বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনগুলোতে। গোপালগঞ্জের এসপি থাকাকালীন মাসুদুর শেখ পরিবারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। বিশেষ করে তিনি শেখ হেলালের খুব আস্থাভাজন ছিলেন। অথচ তিনি একজন ‘অযোগ্য কর্মকর্তা’ হিসেবে পরিচিত। শুধু হাসিনার দোসর হিসেবে পদোন্নতি পান এসবি মনির ও শেখ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন আবদুল আলিম মাহমুদ ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তাকে ওই ব্যাচ এমনকি ১২তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি দেয় শেখ হাসিনার সরকার। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবে বিএনপি-জামায়াত নিধনের কাজে ছিলেন এককাঠি সরেস। দায়িত্বে ছিলেন রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে। পুলিশ সুপার হিসেবে ছিলেন নোয়াখালী, নড়াইল ও মৌলভীবাজার জেলায়। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার থাকাকালে ২০১৮ সালের বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের ব্যাপক কারচুপি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে আলিমের বিরুদ্ধে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন আলিম। শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রায়ই কথা বলা ও দেখা করতেন তিনি। বর্তমানে তাকে ওএসডি করে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করে রাখা হলেও বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরোধী মিটিংয়ে অংশ নেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ভারতে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা ও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ভারতে পলাতক এসবির সাবেক প্রধান মনিরুলের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রাখার অভিযোগ রয়েছে। পতিত সরকারের আইজিপি শহীদুল হকের ছিল ব্যাপক দহরম-মহরম। তাকে ‘ধর্ম ছেলে’ হিসেবে ডাকতেন শহীদুল। নামে-বেনামে তার রয়েছে বিপুল সম্পত্তি।
ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার নেতৃত্ব দেওয়ায় সাধারণ ছাত্ররা আলীমের ২৩৪ নম্বর কক্ষ ভাঙচুর করেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে তাকে সান্ত্বনা দেন। সেই সময়কার একটি ছবি আবদুল আলীমের কাছে সংরক্ষিত ছিল। ছবিটিকে পুঁজি করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে এই কর্মকর্তা পুলিশের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেন।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘ছাত্রলীগের সাবেক নেতা’ পরিচয় ব্যবহার করতেন। কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর রংপুরে ‘মানবতার বন্ধন’ নামে একটি কথিত সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন আলীম। পরে এই সংগঠেনের আড়ালে ব্যবসায়ী, মাদক কারবারিসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ডোনেশন নেন তিনি।
আবু হাসান মুহাম্মদ তারিকও অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পান একই প্রক্রিয়ায়। দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় উত্তীর্ণ হওয়ায় পুলিশ সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পদে ছিলেন। ছিলেন ডিআইজি ফাইন্যান্স, এইচআরসহ পুলিশ সদর দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে। বর্তমানে তিনি মিরপুর পুলিশ একাডেমির রেক্টর হিসেবে রয়েছেন। এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, আতিকুল, প্রলয় ও হাসানুল হায়দারদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে একত্রে সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেন। জুনিয়র তবে তৎকালীন সময়ে ব্যাপক ক্ষমতাবান প্রলয় কুমার জোয়ার্দারের একান্ত অনুগত হিসেবে পরিচিত ছিলেন এই সিনিয়র কর্মকর্তা। তারিক রাজশাহীর সারদায় পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রলয় ছিলেন পুলিশ সদরদপ্তরে। সে সময় সারদার পুলিশ একাডেমির বিভিন্ন কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতেন প্রলয়। সবকিছু অত্যন্ত আনন্দচিত্তে মেনে নিতেন এবং জুনিয়র অফিসারের মন জয় করার মানসিকতা নিয়ে সে সময় পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে ব্যাপক সমালোচনার তৈরি করে।
অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার আগে আওয়ামী সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টে অনুগত অফিসার হিসেবে উল্লেখ করা হয় তারিকের বিষয়ে।
নৌপুলিশের প্রধান এবং বর্তমানে অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ানের বিষয়ে গোয়েন্দা রিপোর্টে সে সময় বলা হয়েছিল, এই কর্মকর্তা আওয়ামী মনোভাবাপন্ন। পরিবারের সদস্যরা মুজিববাদী আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। তার শ্বশুর শরদিন্দু শেখর চাকমা ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার সময়ে ভুটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। শেখ হাসিনার সময়ে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পুরুস্কৃত হওয়া এই কর্মকর্তা এখনো নৌপুলিশের প্রধান হিসেবে বহাল রয়েছেন।
ডিআইজি একেএম এহেসান উল্লাহ ছিলেন ২০তম বিসিএস ব্যাচের ফ্যাসিবাদের অন্যতম দোসর। দুর্নীতিবাজ এই পুলিশ কর্মকর্তার আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য অনেকটাই বংশানুক্রমিক। পিরোজপুরের সন্তান এহসানের দাদা আবদুস সোবহান ছিলেন শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর। ১৯৪৮ সালে ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে আবদুস সোবহান পিরোজপুর মহকুমার প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন সময়ে সেই সম্মেলনে যোগ দেন এবং পিরোজপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন। দক্ষিণবঙ্গে সফর করলে ডিআইজি এহসান উল্লাহর দাদার বাড়ি পিরোজপুরের সোবহান মঞ্জিলেই রাতে থাকতেন শেখ মুজিব। এই কর্মকর্তার পরিবার আওয়ামীপন্থি এবং চরমভাবে বিএনপি-জামায়াতবিদ্বেষী বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
এহসান বরিশাল বিভাগের ডিআইজির দায়িত্ব পালনকালে সাদিক আব্দুল্লাহর গৃহপালিত কর্মকর্তা হিসেবে তখন ওই এলাকায় বেশ আলোচিত ছিলেন। বরিশাল বিভাগে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের ওপর চরম অত্যাচার-নির্যাতনের অন্যতম মাস্টার-মাইন্ড তিনি। সব সময় থাকতেন আড়ালে। মিডিয়াকে এড়িয়ে চলতেন সচেতনভাবে।
৫ আগস্টের পর এহসানের বিরুদ্ধে বরিশালে জুলাই বিপ্লবে হত্যা এবং হত্যাচেষ্টার ঘটনায় মামলা হয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে নিজের ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন বলে পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত একাধিক সূত্রে জানা গেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অবৈধ অর্থ-সম্পদ দিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে পূর্বাচলসহ বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনেছেন। রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর। আওয়ামী লীগের ৯৬ থেকে ২০০১ সময়ের শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত বিসিএস ২০তম ব্যাচের অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা কোনো না কোনোভাবে মুজিববাদের অনুরক্ত বলে পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপকভাবে আলোচনা রয়েছে। ডিবি হারুনসহ ছাত্রলীগের সাবেক অনেক নেতা এই ব্যাচের কর্মকর্তা।
১৮তম ব্যাচের ডিআইজি কাজী জিয়া উদ্দিন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের চাচাত ভাই। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডামি ভোটের নির্বাচনে হাবিবুল আউয়ালের ভূমিকা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ধীকৃত ও নিন্দিত হয়। শেখ হাসিনার সুবিধাভোগী পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (এইচআর) হিসেবে দাপটের সঙ্গে চাকরি করেন। ছিলেন পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট শাখা-১-এ। ঘুরে ফিরে ঢাকায় থেকেছেন তিনি। তবে এখনো বহাল তবিয়তে এই কর্মকর্তা।
২০তম ব্যাচের আবদুল্লাহ হিল বাকী। ঘুরেফিরে পুলিশ সদর দপ্তরে ছিলেন আওয়ামী লীগ শাসনামলে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কনফিডেনশিয়াল শাখায় দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আইজিপির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ অফিসারদেরই সাধারণত এই শাখায় পদায়ন করা হয়। পারসোন্যাল ম্যানেজমেন্ট শাখা-২-এ দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক আইজিপি বেনজিরের সঙ্গে ছিল দহরম-মহরম সম্পর্ক। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে পুলিশ সদর দপ্তরে থেকে যান। এখনো রয়েছেন ডিআইজি হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তরে।
গোলাম রউফ খান বর্তমানে রেলওয়ে পুলিশে (ডিআইজি) কর্মরত। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় খুলনা জেলার এসপি ছিলেন তিনি। নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে রীতিমতো বিএনপি-জামায়াতের ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হন এই কর্মকর্তা। ক্ষমতার জোরে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে বর্তমান ক্ষমতাবান এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ১৮তম ব্যাচের এই কর্মকর্তার হাত থেকে অসহায় মানুষদের রক্ষা করতে সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে গত ৮ মে সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়।
১৮তম ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা রখফার সুলতানা খানম ধারাবাহিকভাবে সুবিধাভোগী ছিলেন শেখ হাসিনার সময়ে। হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি হিসেবে এখনো রয়েছেন বেশ।
১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা ডিআইজি রুহুল আমিন ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় দিনাজপুরের এসপি ছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি ওই জেলায় বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের দমন-নিপীড়নে তার ভূমিকা ছিল সে সময় ব্যাপক আলোচিত। পুলিশ সদর দপ্তরে পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট শাখা-১ এবং ট্রান্সপোর্ট শাখাসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে সুবিধা নিয়ে ৫ আগস্টের পর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন।
ডিআইজি রেজাউল হায়দার ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা। ছিলেন রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক, র্যাবের সিও, সিআইডিতে ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। ফরিদপুরের আলোচিত, চাঞ্চল্যকর বরকত-রুবেল দুই ভাইয়ের মামলার তদন্ত কাজে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে সিআইডিতে থাকাকালীন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময়ে প্রভাবশালী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তখন কেউ কিছু বলার সাহস পাননি।
১৮তম ব্যাচের অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তা ডিআইজি আক্তারুজ্জামান শেখ হাসিনার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সম্ভব অনেক কিছুই করেছেন। পিরোজপুর ও বরিশাল জেলার এসপি হিসেবে রাজ করে বেড়িয়েছেন। ছিলেন বরিশাল জেলার ডিআইজি হিসেবে। পিরোজপুরের বিতর্কিত ও বিএনপি-জামায়াতের ত্রাসখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা মিরাজ-মহারাজ গংদের হয়ে সব ধরনের অপরাধে সহযোগিতা করেছেন তিনি। শেখ হাসিনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পিএস পলাতক অতিরিক্ত সচিব হারুনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই কর্মকর্তা এখনো পুলিশ বাহিনীতে বহাল তবিয়তে থাকায় রীতিমতো হতবাক পুলিশের সংশ্লিষ্টরা।
১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা মফিজ উদ্দিন ছিলেন ঢাকার লালবাগ ডিভিশনের ডিসি। কুষ্টিয়া জেলার এসপি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এন্টি টেরোরিজম ইউনিটে (এটিইউ) ডিআইজি হিসেবে কাজ করেছেন। সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবেও ছিলেন শেখ হাসিনার সময়ে। যেখানেই দায়িত্বে ছিলেন সেখানেই বিএনপি-জামায়াত নিধনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
ব্যাচটির কর্মকর্তা কামরুল আহসান ডিআইজি (কনফিডেন্সিয়াল) হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তরে রয়েছেন এখনো। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পুলিশ বিভাগে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। জেলা পুলিশের এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একই ব্যাচের রেজাউল ডিআইজি (অপারেশন) হিসেবে সদর দপ্তরে শহিদুল হকের স্টাফ অফিসার ছিলেন। শহিদুল হকের অন্যতম ক্যাশিয়ার ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের সাবেক আইজিদের মধ্যে অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন একেএম শহিদুল হক। কট্টরপন্থি আওয়ামী লীগার হওয়ায় তৎকালীন আইজিপি শহিদুল হক এই পুলিশ কর্মকর্তা রেজাউলকে স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেন।
৫ আগস্টের পর প্রথম সপ্তাহে ডামাডোলের মাঝে ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে যান আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা কামরুল আহসান ও রেজাউল। আওয়ামী শাসনামলে নিয়মিত প্রমোশন পেয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি হন এই দুজন। একপর্যায়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতিতে পিছিয়ে পড়েন। তবে শেখ হাসিনার ডামি ভোটের আগে ডিআইজি হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত ৭৬ জনের মধ্যে এই দুই কর্মকর্তার নাম ছিল বলে সূত্রে জানা গেছে। পালিয়ে যাওয়ায় ওই দফায় প্রমোশন না পেলেও ৫ আগস্টের পর নিজেদের আওয়ামী বিরোধী হিসেবে জাহির করে অতিরিক্ত ডিআইজি থেকে ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। দীর্ঘদিন পুলিশ সদর দপ্তরে থাকা এই দুই কর্মকর্তা এখনো বেশ ক্ষমতাবান বলে পুলিশ সদর দপ্তরে কান পাতলেই শোনা যায়।
এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমের সঙ্গে কথা বলার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।