Image description

শেষ পর্যন্ত একীভূতকরণ থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে এক্সিম ব্যাংককে। এক্সিম ব্যাংকের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সেখান থেকে সরে আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তার মধ্যে আর্থিক সূচকে ভালো অবস্থানে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে একীভূত করা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে ব্যাংকটিকে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসাইন খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আওতায় ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’ এক্সিম ব্যাংকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অধ্যাদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যাংককে জোর করে একীভূতকরণ করবে না। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্যের ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই একীভূতকরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। কোনো ব্যাংক যদি একীভূত হতে না চায়, তাহলে অবশ্যই সেটি বিবেচনা করা হবে। যদিও কোন কোন ব্যাংক একীভূত হচ্ছে, তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে জুলাই মাসেই একীভূতকরণের প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হবে বলেও জানান তিনি। 

এদিকে এক্সিম ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আবেদন জানিয়েছেন যে তারা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না হয়ে স্বতন্ত্রভাবে ব্যাংকটি পরিচালনা করতে চান। এক্সিম ব্যাংকের আবেদন বিবেচনাধীন রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র নিশ্চিত করেছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যে বিবেচনায় পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে এক্সিম ব্যাংক পড়ে না। আমাদের আমদানি-রপ্তানি এখনো নিয়মিতভাবে হচ্ছে। ঋণ আদায়ও হচ্ছে। আদায় না হলে অবশ্যই আমরা মামলায় যাব। সে নজরুল ইসলাম মজুমদার হোক বা যে কেউ হোক। একীভূত করার ঘোষণার কারণে আমাদের গ্রাহকরা আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন। একজন নজরুল ইসলামের জন্য তো একটি ভালো ব্যাংক ধ্বংস করা ঠিক হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘বাকি চারটি ব্যাংকের সঙ্গে এক্সিম ব্যাংকের একীভূতকরণের কোনো যুক্তি নেই। আমাদের একীভূত করা হবে না, এই ঘোষণা দিলেই এক্সিম ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললে আগামী বছরে নতুন রূপে ফিরবে এক্সিম ব্যাংক। এ বিষয়টিই আমরা গভর্নর মহোদয়কে জানিয়েছি।’ 

জানা গেছে, যে পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক এর মধ্যে রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। ইতোমধ্যে এসব ব্যাংকে ফরেনসিক অডিটের মাধ্যমে সম্পদের গুণগত মান যাচাই (অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ- একিউআর) করা হয়েছে। সম্প্রতি এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করে একীভূত করার প্রাথমিক পর্যায়ের রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাকি চার ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না এক্সিম ব্যাংক। কারণ বাকি ব্যাংকগুলোর তুলনায় আর্থিক সূচকে এক্সিম ব্যাংকের অবস্থান তুলনামূলক ভালো। ফলে এই পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হলে এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহকরাও অনিশ্চয়তায় পড়বেন। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে পারেন অনেক গ্রাহক। এক্সিম ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদও এই একীভূতকরণের উদ্যোগে রাজি নয়। তারা বলছে, সংকট কাটিয়ে এক্সিম ব্যাংক ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

এ ছাড়া এসব ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালক ও শেয়ারধারীদের কোনো ধরনের মতামত ছাড়াই সরকারি সিদ্ধান্তে ব্যাংকটিকে একীভূত করার উদ্যোগ কতটা কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে। 

এদিকে ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সমস্যার মূলে না গিয়ে পাঁচটি বা দশটি ব্যাংক একীভূত করা হলে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানা হচ্ছে না বলেও মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট অনেকে। এই প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা সমাধান করা যাবে না। বরং আরও নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করলেই হবে না। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। 

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘এখন পাঁচটি বা দশটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করা হলেই যে একটা শক্তিশালী ব্যাংক হয়ে যাবে, এর তো কোনো গ্যারান্টি নেই।’

জানা গেছে, সরকার এই পাঁচটি ব্যাংককে একত্র করে নতুন একটি ব্যাংক করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। শুরুতে নতুন এই ব্যাংককে প্রয়োজনীয় মূলধনের জোগান দেবে সরকার। পাঁচটি ব্যাংক মিলে এক হওয়া ব্যাংকটির প্রধান কাজ হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) অর্থায়ন করা। এই ব্যাংকের অনুমোদন (লাইসেন্স) দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সেই ব্যাংকের অধীনে পাঁচ ব্যাংকের আমানত ও সম্পদ স্থানান্তর করা হবে। 

এক্সিম ব্যাংকের তথ্য বলছে, রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি আয় আহরণকারী ব্যাংকের একটি। সরকার বদলের পর এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠিত হলেও টাকা তুলতে গিয়ে কোনো গ্রাহক সমস্যায় পড়েননি। গত ৯ মাসে ব্যাংকটির গ্রাহকরা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। এসব অর্থ তুলে নিতে গ্রাহকদের কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। এ ছাড়া খেলাপি ঋণে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায়ও এক্সিম ব্যাংক নেই। অন্য অনেক ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়লেও এক্সিম ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি নেই। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব বিবেচনায় পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে, তার কোনোটিতেই এক্সিম ব্যাংক পড়ে না।

জানা যায়, ২০২৪ সালে এক্সিম ব্যাংক আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ৫০ হাজার ৩৮১ কোটি টাকার ব্যবসা করে। আর চলতি বছরে মে মাস পর্যন্ত ব্যবসা করেছে ১৮ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা, যা বাকি চার ব্যাংকের চেয়ে বেশি। গত ১০ মাসে এক্সিম ব্যাংকে ২ লাখ ৯৪ হাজার নতুন হিসাব খোলা হয়েছে। এ সময়ে নতুন আমানত এসেছে ১০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ সময় ঋণ আদায় হয়েছে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে সারা দেশে এক্সিম ব্যাংকের ১৫৫ শাখা ও ৭৪টি উপশাখা রয়েছে। ব্যাংকে কর্মরত ৩ হাজার ৩৯৩ জন কর্মী। ব্যাংকটির মোট গ্রাহকের সংখ্যা ১৬ লাখ ৬৪ হাজার। গত মে মাস শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকায়, ঋণ বা বিনিয়োগের পরিমাণ ৫৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা।