
দেশের নতুন রাজনৈতিক সমঝোতা ও সংস্কার কাঠামো গঠনের লক্ষ্য নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই চলছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই বৈঠকে অনেক বিষয়েই ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে আবার দ্বিমতও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংবিধান সংস্কার থেকে শুরু করে সাংবিধানিক নিয়োগ প্রক্রিয়া, দ্বিকক্ষ সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, এমনকি প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সবই এখন আলোচনার টেবিলে। তবে এসব আলোচনায় যেমন কিছু বিষয়ে আশার আলো দেখা যাচ্ছে, তেমনি অনেক বিষয়েই তৈরি হচ্ছে দ্বিধা, সংশয় আর রাজনৈতিক বিভক্তি। সংলাপের উল্লেখযোগ্য সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ দেয়া, ১০০ নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি), প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্ধারণ, সংবিধানের মূলনীতি, নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো, প্রেসিডেন্টের ক্ষমা প্রদর্শনের বিধান, বিচারব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্য তৈরির পাশাপাশি কাঠামোগত দিক নিয়ে ভিন্নমত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
টানা সংলাপের পরও দলগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে বড় ধরনের ব্যবধান থেকে যাওয়ায় কমিশন এখন কৌশল বদলাতে শুরু করেছে। প্রকাশ্য সংলাপে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নেপথ্যে প্রভাবশালী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা চলছে। একইসঙ্গে যেসব প্রস্তাব নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর মূল ধারণা ঠিক রেখে কিছুটা শিথিল করা যায় কিনা, তাও বিবেচনা করা হচ্ছে।
সংলাপে এ পর্যন্ত দুই ধাপে ৫৪টি অধিবেশনে কথা হয়েছে। প্রথম ধাপে পৃথকভাবে ৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশনে কমিশন মতবিনিময় করেছে। দ্বিতীয় ধাপে সব দল ও জোটের সঙ্গে একসঙ্গে আলোচনা চলছে।
কমিশন সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত যেসব বিষয় আলোচনা ও নিষ্পত্তি হয়েছে তার মধ্যে আছে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, প্রেসিডেন্টের ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান।
যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু নিষ্পত্তি হয়নি: সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি (যা পূর্বে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ বা ‘এনসিসি’ নামে প্রস্তাবিত ছিল), দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট (উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি), সংসদে নারী আসন (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি), প্রেসিডেন্টের নির্বাচন পদ্ধতি, রাষ্ট্রের মূলনীতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ।
নির্ধারিত যেসব বিষয় এখনো আলোচনার জন্য উত্থাপিত হয়নি: এ ধাপের বৈঠকে এখনো কিছু বিষয় উত্থাপিত হয়নি। এর মধ্যে আছে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, সংসদ সদস্যদের একাধিক পদে থাকার বিধান, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, সংবিধান সংশোধন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]।
নিয়োগ কমিটি নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু: প্রথম থেকেই বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে সাংবিধানিক পদে নিয়োগ কমিটি নিয়ে। শুরুতে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)’ নামে প্রস্তাব এলে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আপত্তিতে নাম পরিবর্তন করে করা হয় ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ কমিটি’ নামে। এই কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়ার কথা বলেছে কমিশন। বিএনপি বলছে, এই কমিটির মাধ্যমে সরকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার নতুন পথ তৈরি করছে।
দ্বিকক্ষ সংসদ: বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন: কমিশনের আলোচনায় প্রস্তাবিত সংসদের উচ্চকক্ষ নিয়ে আলোচনা তীব্র হচ্ছে। ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলেও, বিএনপি ও কিছু রাজনৈতিক দল উচ্চকক্ষে নিয়োগ বা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তাদের মতে, সুনির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ রূপরেখা ছাড়া এভাবে উচ্চকক্ষ চালু হলে ক্ষমতার ভারসাম্য আরও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল: আপাতত ঐকমত্য, শর্তের বেড়াজাল: প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণের প্রস্তাবে প্রায় সব দলের সম্মতি থাকলেও, বিএনপি স্পষ্ট জানিয়েছে, নিয়োগ কমিটির কাঠামোর ওপর তাদের চূড়ান্ত অবস্থান নির্ভর করছে। নিয়োগ কমিটিতে সরকার প্রভাব ধরে রাখলে তারা এই মেয়াদকালের প্রস্তাব মেনে নেবে না।
‘জুলাই সনদ’ সময়ের চাপ বাড়ছে: কমিশনের লক্ষ্য জুলাই মাসের মধ্যেই জাতীয় সনদ বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার। তবে ১৬ই জুলাই, শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করার বিষয়ে ভাবছে কমিশন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, কাঠামোগত জটিলতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বিভিন্ন দলের শর্তপূর্ণ অবস্থানের কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সনদ ঘোষণা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, স্বপ্ন দেখেছিলাম, শহীদ আবু সাঈদের শাহাদতবার্ষিকীতে সবাই মিলে ‘জুলাই সনদ’-এ স্বাক্ষর করবো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর অনীহা এবং দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে আমরা সে পথে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারিনি। এই মুহূর্তে আমরা কিছুটা শঙ্কিত।
রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্বেগ-সংশয়: নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার স্বপ্ন নিয়ে শুরু হলেও, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগ পুরনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর অবিশ্বাসের দেয়ালে অনেক বিষয়েই এখনো চূড়ান্ত ঐকমত্য তৈরি হয়নি। আগামী কয়েকটি বৈঠক তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে কাঠামোগত সমঝোতা সম্ভব না হলে, দেশের সামনে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কমিশনের আলোচনা কাঠামোগত পর্যায়ে এসে জটিল হয়ে পড়ছে। বিএনপি’র সরাসরি আপত্তি, জামায়াত-এনসিপি’র শর্তপূর্ণ সমর্থন এবং বিভিন্ন দলের দ্বিধা পুরো প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করে তুলছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জনগণের কাছে আমাদের দায় অনেক বেশি। এখানে মতামত দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ সহযোগিতা কারা করছে, তা জনগণ বিবেচনা করবে। দ্রুত জাতীয় সনদ প্রণয়ন হোক, বিএনপি তা চায়।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের মানবজমিনকে বলেন, অনেকগুলো সংস্কার নিয়ে সবাই ঐকমত্য হলেও কিছু মৌলিক সংস্কারে এখনো ঐকমত্য হয়নি এ বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতি রয়েছে। আশা করছি জুলাইয়ের মধ্যে সবাই ঐকমত্যে আসবে। বিএনপি’র মতের সঙ্গে যেগুলো মিলে যাচ্ছে, সেগুলোতে সহজে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাচ্ছে বাকিগুলোতে আলোচনা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) মহাসচিব মোমিনুল আমিন মানবজমিনকে বলেন, আমরা সংস্কারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ ছাড়ের মানসিকতা নিয়ে এগোচ্ছি। যেখানে মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে সেখানে জাতির স্বার্থে আমরা ছাড় দিয়ে এগোচ্ছি। কিছু কিছু দল নির্বাচনী পরিবেশ ঘোলা করার জন্য সংস্কার কমিশনের ভেতরে ও বাইরে কথা বলছে। যারা হঠাৎ করে পিআর, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চায়, গণঅধিকার পরিষদ নির্বাচন চায় এ ধরণের কথাবার্তা যারা বলছে। তারা নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব কথা বলছেন, এ ছাড়া জুলাই সনদ নিয়ে আমরা কোনো শঙ্কার জায়গা দেখি না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রত্যাশিত জুলাই সনদ গণঅভ্যুত্থানের এই মাসেই সম্ভব। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা যথেষ্ট অগ্রগতি হিসেবে দেখছি। আশঙ্কা ছিল রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটাই অনমনীয় অবস্থান নেবেন, কিন্তু তার পরিবর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যে আসার আন্তরিক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সকল প্রশ্নে আমরা একমত হতে পারবো না, সেটার বাস্তবতাও নেই। অনেক প্রশ্নের সঙ্গে আদর্শগত প্রশ্ন যুক্ত। জুলাই সনদের ভিত্তি হবে যেসব বিষয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলো ন্যূনতম একমত হতে পারবো। আমরা শতভাগ অর্জন করতে পারবো এই চিন্তা বাদ দিতে হবে।
তিনি বলেন, যে বিষয়গুলোতে একমত হবে না। সেসব বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনার জন্য থাকবে। দলগুলো তাদের নির্বাচনী ঘোষণায় বিষয়গুলো রাখতে পারবেন। ভবিষ্যতে সংসদে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
অনেকগুলো ইস্যু আছে ৫/১০ বছর লাগবে অর্জন করতে। কেউ যদি চিন্তা করে যে জুলাই সনদে সব ব্যাপারে একমত হবো, এখানে একটা স্বর্গরাজ্য তৈরি হবে, এটা চূড়ান্ত একটি বোকামি। ভিন্নতা নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুদার মানবজমিনকে বলেন, আলোচনা শুরু করেছি, এটা অব্যাহত থাকবে। আমরা আশাবাদী অনেকগুলো বিষয়ে একমত হতে পারবো। অনেকগুলো বিষয় নতুন ও স্পর্শকাতর, যেগুলোর জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান স্পষ্ট-এরকম অনেকগুলো বিষয়ে আমরা একমত হতে পেরেছি, এখনো অনেকগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেসব বিষয় নিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে বিকল্প ৬টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে কমিশনের কোনো অবস্থান নেই। রাজনৈতিক দলগুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতেই করার চেষ্টা করছি। আমরা সর্বাত্মাকভাবে চেষ্টা করবো ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য। শেষ পর্যন্ত যদি না হয়, তাহলে যারা দ্বিমত পোষণ করবে তাদের জন্য ‘নোট অব দ্য ডিসেন্ট’ এই জাতীয় কিছু থাকবে।