Image description

জুলাই বিপ্লবের এক বছর পার হলেও চট্টগ্রামে জুলাই আন্দোলনে ত্রিমুখী হামলায় আহত সাংবাদিকদের খোঁজ না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের জুলাই-আগস্টে আহত যোদ্ধাদের নামের তালিকাতে তাদের ঠাঁই হয়নি বলেও গুঞ্জন রয়েছে। জোটেনি চিকিৎসা খরচসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। বেসরকারি হাসপাতালে ব্যক্তিগত খরচে নিয়েছেন চিকিৎসা।

অভিযোগ আছে, জুলাই আন্দোলনে ত্রিমুখী হামলা ও মারধরের পর অনেক সাংবাদিক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেননি। তখন সরকারি হাসপাতালে জুলাই আন্দোলনে আহত ব্যক্তির সংখ্যা বেশি ছিল। তাই বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাসায় চিকিৎসা নিয়েছেন। এর কোনো কাগজপত্র না থাকলেও হামলার শিকারের ছবি রয়েছে। আবার অনেকের কাগজপত্র পাঠানো হলেও সরকারি গেজেট পর্যন্ত সেগুলো পৌঁছায়নি বলেও মনে করছেন অনেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুলাই আন্দোলনে চট্টগ্রামে একজন ফটোসাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অনেকে মাথায়, পায়ে, পিঠে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। টিয়ার শেলেও আহত হয়েছেন। মারধরের শিকার অনেকে পরিহিত ছেঁড়া জামার ছবিও রয়েছে। টিয়ার শেলের প্রভাবে অনেকে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লে সহকর্মীরা চোখের সামনে গ্যাস লাইট (আগুন) জ্বালিয়ে দৃষ্টিশক্তি ফেরানোর চেষ্টা করছেন।

তৎকালীন চমেক হাসপাতালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মোহাম্মদ এনামুল হক কালবেলাকে বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে জুলাই আন্দোলনে আহত সাংবাদিকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা যেগুলো করেছি তার মধ্যে সাংবাদিক হিসেবে আলাদা কোনো চিহ্নিত করা হয়নি। কারও যদি মেডিকেল ডকুমেন্টস থাকে, সে যদি আন্দোলনে আহতের ছবি দেখাতে পারে; অন্যদের মতো সেও অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে জার্নালিস্ট হিসেবে আলাদা কোনো স্বীকৃতি নেই।

জুলাইয়ে আহত সাংবাদিকদের খোঁজ নেয়নি কেউই!
আহতের ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আহতের মধ্যে মারধরের শিকার, গুলিবিদ্ধ ইত্যাদি। তারা সব কাগজপত্র দেওয়ার পর ডাক্তার এবং আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে যাচাইবাছাই করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম তথ্য অফিসের ডিপিও কর্মকর্তা মো. আহসান কালবেলাকে বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয় বা তথ্য অফিস বা তালিকা সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় বা তথ্য অফিসের কারও হাত নেই। যতদূর জানি, আবেদনকারীরা সশরীরে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। জুলাই বিপ্লব ফাউন্ডেশনে এখনো প্রক্রিয়া চলছে। এখনো অনেকে অনেক কিছু পায়নি।

তথ্যমতে, জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকে সংবাদ ও ছবি সংগ্রহ করতে সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার পরও চট্টগ্রামে জুলাই আন্দোলনের সার্বিক পরিস্থিতি ও ছবি পাঠিয়েছিলেন, যাতে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তবে জুলাই আন্দোলনে হামলার শিকার হওয়া সাংবাদিকরা মূল্যায়িত হয়নি এখনো। শরীরে আঘাত নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে।

জুলাইয়ে নগরীর মুরাদপুর, দুই নম্বর গেট, বহদ্দারহাট এলাকা এবং ৪ আগস্ট নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় বেধড়ক মারধর, হামলার শিকার হন তারা। এসময় অনেকের ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়েছে। এরপরও জুলাই আন্দোলনে ছবি কভারেজে পিছপা হননি তারা।

এ আন্দোলনে মারধরের শিকার আহত সাংবাদিকরা হলেন- দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটোসাংবাদিক ও বাংলাদেশ ফটোসাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, দৈনিক পূর্বকোণের ফটোসাংবাদিক মিয়া আলতাফ, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জাহেদ তালুকদার, দৈনিক বণিক বার্তার ফটোসাংবাদিক আজীম অনন, দৈনিক দেশ রূপান্তরের আকমাল হোসেন, ডেইলি সান পত্রিকার রবিন চৌধুরী ও দৈনিক কালবেলা পত্রিকার ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ সুমন।

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে জুলাই আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে হামলা ও বেধড়ক মারধরের শিকার হন বাংলাদেশ ফটোসাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটোসাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান, দৈনিক পূর্বকোণের ফটোসাংবাদিক মিয়া আলতাফসহ অনেকে। পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলে আহত হন দৈনিক কালবেলা পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান সাইদুল ইসলাম, দৈনিক বণিক বার্তার চট্টগ্রাম ডেপুটি ব্যুরো সুজিত সাহা, দীপ্ত টিভির ব্যুরো প্রধান লতিফা রুনা আনসারি ও বণিক বার্তার ফটোসাংবাদিক আজীম অনন। নগরীর চেরাগীপাহাড় মোড়ে হামলা ও মারধরের শিকার হন দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার ফটোসাংবাদিক আকমাল হোসেনসহ অনেকে।

জুলাই আন্দোলনে ভূমিকার স্মৃতিচারণ করে বাংলাদেশ ফটোসাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রামের সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের ফটোসাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে অনেক সাংবাদিক হামলা, মারধরসহ গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় অস্ত্রধারী অনেকের হামলার শিকার হন ফটোসাংবাদিক মিয়া আলতাফ, শরীফ চৌধুরী, আজীম অনন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জুলাই বিপ্লবের এক বছর হয়ে গেলেও এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো প্রতিনিধি আমাদের খোঁজখবর বা যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি।

ফটোসাংবাদিক মিয়া আলতাফ বলেন, জুলাই আন্দোলনে সাংবাদিকরা সরকারদলীয় সমর্থকদের মারধরের শিকার হয়েছেন।

ফটোসাংবাদিক আকমাল হোসেন বলেন, জুলাই আন্দোলনে গণমাধ্যম কর্মীদের অবদান বেশি ছিল। আমরা ফটোসাংবাদিকরা পুলিশ ও সরকারদলীয় লোকজনের মাঝখানে থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছি। অনেকবার মারধরের শিকারও হয়েছি। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়ে কেউ আলোচনা বা কথাই বলেন না। ২৯ জুলাই চেরাগীপাহাড় এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পুলিশ গ্রেপ্তারের সময় বাধা দিলে সরকারদলীয় লোকজনের বেধড়ক মারধরের শিকার হই। পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলের গ্যাসে আজীম অনন, বার্তা ২৪-এর সিরাত মঞ্জু ও আমি মাটিতে লুটে পড়ি। এরপর আবারও মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, নিউমার্কেট এলাকায় ত্রিমুখী হামলার শিকার হই। এক বছর ঘুরে জুলাই এলো। এ জুলাইয়ে গত বছর জুলাইয়ের স্মৃতি আজও কাঁদায়। এখন পর্যন্ত দায়িত্বরতরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বা খোঁজখবর নেয়নি।

ফটোসাংবাদিক আজীম অনন বলেন, জুলাই আন্দোলনে অনেক সাংবাদিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সহকর্মীদের কাছে ছবিও রয়েছে। আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলেও চিকিৎসা পর্যন্ত পায়নি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের নাম থাকলেও অনেক আহতের ডাটাও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যায়নি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক নীল আফরোজ কালবেলাকে বলেন, আন্দোলনে সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল। তাদের মধ্যে হলুদ সাংবাদিকও ছিল। আমি অনেক সাংবাদিকের খোঁজখবর নিয়েছি, এখনো যোগাযোগ আছে। জুলাই-আগস্টে আহতদের কয়েকটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছিল। যেমন- অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, অনেকে মারধরের শিকার হয়েছেন। যেহেতু তখন এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দুজন সমন্বয়ক কাজ করেছিলেন। তারাই ভালো জানবেন।

উল্লেখ্য, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক তালিকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে সারা দেশে শহীদ/আহত সাংবাদিক ৩০৭ জনের নাম রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় ১৩১ জন, চট্টগ্রামে ৯ জন, সিলেটে ২৫ জন, বরিশালে ৫ জন, যশোরে একজন, রাজশাহীতে একজন, দিনাজপুরে একজন, খুলনায় একজন, নারায়ণগঞ্জে ৫ জন, গাজীপুরে ৭ জন, বগুড়ায় ৭ জন, মৌলভীবাজারে ৩০ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজন, খাগড়াছড়িতে ৪ জন, কুষ্টিয়ায় ১০ জন, কক্সবাজারে একজন, রংপুরে একজন, লালমনিরহাটে ৪ জন, ফেনীতে ৮ জন, চাঁদপুরে ৩ জন, নোয়াখালীতে ৪ জন, গাইবান্ধায় একজন, সিরাজগঞ্জে ৫ জন, হবিগঞ্জে একজন, নওগাঁয় দুজন, মাদারীপুরে ৩ জন, চুয়াডাঙ্গায় একজন, নাটোরে ৪ জন, নীলফামারিতে একজন, ভোলায় একজন, নেত্রকোনায় একজন, কিশোরগঞ্জ ৪ জন, জয়পুরহাটে একজন, নড়াইলে একজন, সুনামগঞ্জ একজন, পটুয়াখালিতে একজন, শরীয়তপুরে দুজন, কুড়িগ্রামে ৪ জন, পঞ্চগড়ে দুজন, জামালপুরে একজন, নরসিংদী ৩ জন, সাতক্ষীরায় একজন, মুন্সীগঞ্জে একজন, মাগুরার দুজন ও মানিকগঞ্জে ৩ জন।