
২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন সবে রূপ নিচ্ছে গণঅভ্যুত্থানে। উত্তাল রাজধানী ঢাকায় স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়তে রাস্তায় রক্ত ঝরছে তরুণদের। এরই মধ্যে ঘরে ফেরার কথা ছিল পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার গাড়িচালক আবু জাফর হাওলাদারের। কিন্তু সেদিন তিনি ফিরলেন না— ফিরলেন পরদিন, লাশ হয়ে। পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল তার বুক।
আবু জাফর হাওলাদার ছিলেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার তুষখালী ইউনিয়নের মৃত হাজী আবদুল মজিদের ছেলে। পেশায় ছিলেন শ্যামলী পরিবহনের বাসচালক। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। মাসিক ১৫-১৬ হাজার টাকার আয় দিয়ে তিন সন্তান, স্ত্রী ও বৃদ্ধা মা—ছয়জনের সংসার চালাতেন এই মধ্যবয়সী মানুষটি। আন্দোলনের সেই ১৮ জুলাই, সন্ধ্যায় ঢাকার সায়দাবাদ হুজুরবাড়ি থেকে বাসে ওঠার উদ্দেশ্যে রওনা হলে সেখানেই চলমান ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও পুলিশের দমন-পীড়নের মাঝে পড়ে যান। পুলিশ তাকে আন্দোলনকারী ভেবে মুখোমুখি গুলি ছোড়ে। গুলি বুকে বিঁধে যায়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক নারী আন্দোলনকারী আবু জাফরের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা দেখতে পান। তিনি সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন থেকে পরিবারকে খবর দেন। আন্দোলনকারীরা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন, কিন্তু চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত আবু জাফরের স্ত্রী হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমার সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর বড় ছেলে লেখাপড়া বাদ দিয়ে সুপারভাইজারের চাকরি নিয়েছে, মেজ ছেলে ঢাকায় লেখাপড়া করতে পারছে না। ছোট ছেলে নাইম রাতে ঘুম ভেঙে কাঁদে, ‘আমার আব্বু কই?’ — আমি কী জবাব দেবো?
তিনি বলেন, ‘আমরা বিচার চাই। যে অপরাধ না করেই তাকে হত্যা করা হলো, সেই অন্যায়ের বিচার চাই। আমার ছেলেরা কেন এত অল্প বয়সে পিতৃহারা হবে?’
আবু জাফরের বড় ভাই মো. বেলায়েত হাওলাদার জানান, ভাইয়ের মৃত্যুর পর বাড়িতে এসে ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের লোকজন হুমকি দিয়ে যায়। ‘তারা বলে, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলে বিপদ হবে। প্রশাসনের লোকজন তাড়াহুড়ো করে লাশ দাফনের জন্য চাপ দেয়।’
আবু জাফর বলেন, লাশ গোসলের সময় দেখেছি— গুলি গলায় ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। নিহত আবু জাফরের মেজ ছেলে মো. নুহু হাওলাদার ঢাকার একটি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। বাবার মৃত্যুতে তার লেখাপড়া অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে।
নুহু হাওলাদার বলেন, ‘আমার বাবা ১৭ জুলাই শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ঢাকায় পৌঁছে ১৮ জুলাই রাতে বাস ছাড়ার কথা ছিল। সে সময় ব্যাগ নিয়ে গাড়ির কাছে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। আমরা সরকার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছি, কিন্তু সেই টাকা বাবার পুরনো দেনা পরিশোধেই শেষ হয়ে গেছে। এখন টাকার অভাবে আমি ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছি।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।