Image description

আলফাজ আনাম

 

রক্তাক্ত জুলাই ফিরে এসেছে। যে মাসে শুরু হয়েছিল দানবীয় শাসনের বিরুদ্ধে অন্যরকম এক প্রতিরোধ। শেখ হাসিনার দেড় দশকের দুঃশাসনে বাংলাদেশ আগে থেকেই ছিল অগ্নিগর্ভ। দরকার ছিল স্ফুলিঙ্গের। কোটাবিরোধী আন্দোলন ছিল সেই স্ফুলিঙ্গের নাম। এই আন্দোলনের শুরুর দিকে ছাত্রদের একটি স্লোগান ছিল—সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে। ৩৬ দিনের আন্দোলনে সারা বাংলা যেন জেগে উঠেছিল। শুধু কোটা প্রথা নয়, নিকৃষ্টতম এক স্বৈরশাসনের কবর রচনা হয়েছিল।

ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরানো এই আন্দোলনের এক বছর পর নিরাশা কিংবা হতাশার নানা কথা বলা যাবে। কিন্তু এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে কথা বলার স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া। প্রায় দুই হাজার মানুষের প্রাণদান, হাজারো মানুষের অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে আমরা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পোশাক পরা ও হেলমেট বাহিনীর হাতে খুন হওয়ার শঙ্কা থেকে মুক্ত হয়েছি। আর কোনো আয়না ঘর কিংবা ডিবি অফিসের গোপন কক্ষে কাউকে আটকে থাকতে হচ্ছে না। আমরা তো এই স্বাধীনতাই চেয়েছিলাম।

শেখ হাসিনা তার শাসন টিকিয়ে রেখেছিলেন সমাজকে নানাভাবে বিভাজিত করে একে অন্যের বিরুদ্ধে ঘৃণা উৎপাদন করে। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গুম, খুন ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিলেন ঘৃণার রাজনীতির মাধ্যমে। জুলাইয়ের আন্দোলনে আমাদের বড় অর্জন—এ দেশের মানুষের মধ্যে শেখ হাসিনার শাসনামলে ঘৃণার রাজনীতির যে দুষ্টচক্র তৈরি করা হয়েছিল, তা থেকে মানুষ বেরিয়ে আসে। রাজপথে সব মত-পথ এবং বিশ্বাসের মানুষের একত্র হওয়ার মধ্য দিয়ে এক অভাবনীয় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলাদেশে অতীতেও স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। এমনকি গণঅভ্যুত্থানও হয়েছে। ৬৯-এ পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ও ৯০-এ জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু সেই অভ্যুত্থানগুলোর সঙ্গে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এই প্রথম কোনো আন্দোলন হয়েছে, যেখানে অন্তত ১৩২ জন শিশু-কিশোর প্রাণ দিয়েছে। মারা গেছে ১১ জনের বেশি নারী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে নারীদের অদম্য অংশগ্রহণ অতীতে কখনো দেখা যায়নি। বাবা তার ছেলেকে নিয়ে, মা তার মেয়েকে নিয়ে, ভাই তার বোনকে নিয়ে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। কীভাবে শিশুরা এই আন্দোলনে জীবন দিয়েছে, তার বহু ভিডিও আমরা দেখেছি। আমরা কি ভুলে যেতে পারি শহীদ আনাসের সেই চিঠির কথা। আনাস তার মাকে চিঠি লিখেছিলেন—

‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাইরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম করে যাচ্ছে, অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে, একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষও যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বসে থাকব ঘরে। এক দিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় করে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যুও অধিক শ্রেষ্ঠ। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়, সে-ই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।’ আনাস।

১৭ বছরের এক কিশোর কীভাবে তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেশকে দেখেছে, তাই ফুটে উঠেছে আনাসের চিঠিতে। এই কিশোর জীবন উৎসর্গ করে গেছে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কেন সে জীবন দিয়েছে, এর বিবরণও লিখে গেছে।

শুধু আনাস নয়, জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলোয় আমরা রাজপথে এ রকম হাজার হাজার শিশু-কিশোরকে দেখেছি। পুলিশের গুলির মুখে তারা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে শিশুদের হত্যা ও আহতদের চিকিৎসা প্রদানে বাধা দেওয়ার বেশ কিছু চিত্র উঠে এসেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে এ ধরনের একটি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। ‘৪ আগস্ট পুলিশ ফার্মগেট এলাকায় ১৭ বছর বয়সি এক কিশোরকে গুলি করে আহত করে। এরপর পুলিশ কর্মকর্তারা আহত কিশোরকে একটি রিকশায় তুলে রিকশাচালককে তাকে নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু অন্য পুলিশ সদস্যরা রিকশাটিকে কাছের হাসপাতালে প্রবেশে বাধা দেয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা রিকশাচালক কিশোরকে ড্রেনে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেন, পরে সিদ্ধান্ত বদলে তাকে যেতে দেন। যখন আহত কিশোরকে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তখন সে মারা যায়।’

 

এভাবে শিশু-কিশোররা হয়ে উঠেছিল হাসিনার নিপীড়ক পুলিশ বাহিনীর টার্গেট। যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া নিজ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এভাবে তাদের নাগরিককে হত্যা করার ঘটনা বিরল। এমনকি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার ঘটনাও ঘটেছে। এই আন্দোলনে চোখ হারিয়ে ৬০০-এর মতো লোক অন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে শিশু-কিশোররাও আছে। কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর পেলেট গানে যেভাবে কাশ্মীরিদের অন্ধ করা হতো। ঠিক একইভাবে হাসিনার বাহিনী চোখ লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। আসলে হাসিনার বাহিনী শুধু আন্দোলন দমন করার জন্য এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি, বিক্ষোভকারী মানুষের ওপর ছিল তাদের তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা। অভ্যুত্থানে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণ পুরো আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বদলে দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষদিকে স্কুলগুলো যেন হয়ে উঠেছিল স্বৈরশাসকের পতনের প্রতীক।

 

স্কুলের দেয়ালগুলোয় নতুন প্রজন্মের অব্যক্ত বেদনার কথা লেখা হতে থাকে। রক্তচোষা ফ্যাসিস্ট হাসিনার কার্টুনে ভরে ওঠে স্কুলের দেয়াল। আন্দোলন নিয়ে তার স্বজন হারানোর বেদনার কান্নার নাটকীয়তা শিশু-কিশোরদের মনে আরো ক্ষোভের জন্ম দেয়। ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে একটি গ্রাফিতি ছিলÑ‘নাটক কম করো পিও’। এসব দেয়াললিখনে শিশু-কিশোররা কেমন বাংলাদেশ চায়, আর কেমন দেশ তারা পেয়েছে, সেসব কথাও ফুটে উঠে গ্রাফিতি আর দেয়াললিখনে।

 

গণঅভ্যুত্থানে শিশু-কিশোরদের এই আত্মত্যাগ আশাজাগানিয়া এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়। এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী পর্যন্ত। এদের দেড় দশক ধরে হাসিনার শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ফ্যাসিবাদের নিগড়ে আটকে রাখতে চেয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে মুজিবকে দেবত্বের আসনে বসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শেখ পরিবারকে দেখানো হয়েছিল এ দেশের ত্রাতা এক রাজ পরিবার হিসেবে। কিন্তু ১৫ বছর ধরে চাপানো ইতিহাসের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মগজ ধোলাইয়ের প্রচেষ্টা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। হাসিনার বানানো ইতিহাস পড়ে বড় হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতিতে কুঠারাঘাত করে স্লোগান তুলেছিলÑতুমি কে, আমি কেÑরাজাকার-রাজাকার। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার বিভাজনের রাজনীতির মৃত্যু ঘটে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার বড় ভিত্তি তৈরি করেছিল এই স্লোগান। এরপর বদলে যেতে থাকে আন্দোলনের গতিপথ।

 

শেখ হাসিনার পতনের পর ফ্রান্সের লা মদে ৭ আগস্ট একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যার শিরোনাম ছিল—‘বাংলাদেশ : দ্য ফল অব এ ডাইনেস্টি’ এই প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী তার নিজ দোষেই চেয়ার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে কর্তৃত্বপরায়ণতা, অত্যধিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ও স্বজন তোষণের অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগের ক্ষেত্রে তার অবস্থান হুবহু তার বাবার মতোই। আর এই বাস্তবতাই ক্ষুব্ধ করে তোলে সাধারণ মানুষকে। দেশজুড়ে নির্মিত শেখ মুজিবের ভাস্কর্য হাসিনার পদত্যাগের পর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭১-এর যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ, ১৯৯০-এর গণআন্দোলনের পর ২০২৪ সালের এই বিপ্লব এশিয়ার বংশানুক্রমিক রাজনীতির একটি শক্ত পিলারকে গুঁড়িয়ে দিল।

 

জুলাইয়ের ৩৬ দিনের আন্দোলনে শুধু ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন হয়নি, নতুন এক বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। সেই বাংলাদেশ কীভাবে গড়তে হবে, তার চিন্তা নতুন প্রজন্মের মধ্যে আছে। যারা ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, তাদের হাসিনা পতনের আন্দোলনের সময় দেয়াললিখনের ভাষাগুলো পড়তে হবে। বুঝতে হবে শিশু-কিশোর ও তরুণদের মনের ভাষা। মনে রাখতে হবে, হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ওরা এক নতুন দেশের স্বপ্ন দেখছে। আমরা যদি শিশু-কিশোর-তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে না পারি, তাহলে অচিরেই এর চেয়েও বড় অভ্যুত্থান দেখতে পাব। আগামী দিনে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, এই দেয়াললিখনগুলো তাদের জন্য যেমন শিক্ষা, তেমনি সতর্কবার্তা।

 

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ