
একাধিকবার খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন বিশ্বনাথের তবারক। মানবজমিনেও কয়েকবার তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হয়। পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত অপরাধী। তবু সে ছিল ধরাছোয়ার বাইরে। আড়ালে চলে যাওয়া তবারকের শেষ অস্ত্র ছিল তার স্ত্রী সাবিনা আক্তার। তাকে দিয়েই তার মাদক ও অপরাধ সাম্রাজ্যের হাল ধরিয়েছিল। সেই তবারকের এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। স্ত্রী সাবিনাসহ সেনাবাহিনীর হাতেই গ্রেপ্তার হয়েছে। আর গ্রেপ্তারের পর তবারকের অপরাধ জগতের নানা ঘটনা রটছে মানুষের মুখে মুখে। বিশ্বনাথের রামপাশা ইউনিয়নের পাঠাকইন গ্রামে তবারকের বাড়ি। তবে ঘাঁটি গেড়েছিল বিশ্বনাথ শহরের শরিষপুর, পূর্ব চানশীরকাপন এলাকায়। মাদক ব্যবসা করে সেখানে বাসা নির্মাণ করে বসবাস করতো। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে তবারককে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়ে জানানো হয়েছে- সোমবার ভোরে বিশ্বনাথ থেকেই তবারককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা স্ত্রী সাবিনা আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটকের সময় তাদের কাছ থেকে দা, বঁটি ৪টি, চাপাতি ৫টি, দা ৩টি, বড় ছুরি ১টি, ছোট ছুরি ১৪টি, মোবাইল অ্যান্ড্রয়েড ২টি, মোবাইল বাটন ২টি, চেক বই মোট ১৬টি, মোবাইল সিম ১২টি, ডেবিট কার্ড ৩টি, নগদ টাকা ২ লাখ ১৭ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর ওইদিন বিকালেই তবারককে বিশ্বনাথ থানা পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হয়। বিশ্বনাথ থানার ওসি এনামুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন- গ্রেপ্তার হওয়া তবারক আলী একটি মামলার আড়াই বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। এ ছাড়া আরও একটি মারামারির মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। এই দুই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে সোমবার দুপুরে আদালতে প্রেরণ করা হয়। আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে- সেনাবাহিনীর হাতে আটককৃত তবারক আলীর ওপর ৩টি মাদক মামলাসহ, নারী হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাইসহ মোট ১৬টি মামলা রয়েছে। অপরাধই নেশা তবারকের। তার নেতৃত্বে বিশ্বনাথে একটি চিহ্নিত অপরাধী দল গড়ে উঠেছিল। তার চক্রের বেশির ভাগ সদস্যই নিজ এলাকার বাইরের। দক্ষিণ সুরমার লালাবাজার, অতিরবাড়ি এলাকায় সে আসন গেড়েছিল। বিশ্বনাথ পৌর শহরের দক্ষিণপাড়ের মানুষ জানিয়েছেন- তবারক ছিল ইয়াবা সম্রাট। প্রায় ১৫ বছর আগে সে নিজে ইয়াবা বিক্রি করতো। এরপর ইয়াবার ডিলার হিসেবে পরিচিতি পায়। সিলেট অঞ্চলের বড় বড় ইয়াবার চালান তার হাত দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেতো। তবে অপরাধের শুরু তার গাড়ি চুরির মধ্য দিয়ে।
সিলেট শহরে গাড়ি চোর চক্রের সদস্য হিসেবে গাড়ি চুরি করে বেড়াতো। তার বিরুদ্ধে গাড়ি চুরিরও কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। গাড়ি চুরিতে পরিচিতি পাওয়ার পর সে অপরাধের ধরন পরিবর্তন করে। শুরু করে মাদক ব্যবসা। স্ত্রী সাবিনাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। ১০-১২ বছর আগে বিশ্বনাথ শহরে ভয়াবহ ভাবে ইয়াবার বিস্তার ঘটে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ ইয়াবার দিকে ঝুঁকে। এই অবস্থায় বিশ্বনাথের মানুষই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তবে ওই সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন ক্যাডারের শেল্টারে সে বীরদর্পে বিশ্বনাথ শহরে ইয়াবা ব্যবসা চালায়। বিষয়টি বিশ্বনাথের পুলিশ জানলেও রাজনৈতিক শেল্টার থাকায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। ২০২০ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি তবারকের ইয়াবার একটি বড় চালান ধরা পড়ে হবিগঞ্জে। তার স্ত্রী সাবিনার নিয়োজিত দুই বাহক নাহিদা ও শাহিনা একটি বাসে করে ঢাকায় যাওয়ার পথে হবিগঞ্জের পুলিশ তাদের কাছ থেকে ৬১ হাজার পিস ইয়াবা আটক করেছিল। এটি ছিল সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালান আটকের ঘটনা। আটক চালানের মূল্য ছিল প্রায় দুই কোটি টাকা। গ্রেপ্তার হওয়া দুই নারী ছিলেন তবারক-সাবিনার সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান সদস্য। ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর তারা জানিয়েছিল; বিশ্বনাথের তবারক ও তার স্ত্রী সাবিনার হয়ে তারা কাজ করে আসছে। ঘটনায় মামলা দায়েরের আগেই হবিগঞ্জের ডিবি পুলিশ সিলেট জেলা পুলিশের সহায়তায় তবারক ও স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করতে বিশ্বনাথ ও দক্ষিণ সুরমার একাধিক স্থানে অভিযান চালিয়েছিল। তবে চালান আটকের পর তবারক ও তার স্ত্রী আত্মগোপনে চলে যায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে- ২০১০ সালের ১লা এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিলেট বিভাগের বিভিন্ন থানায় তবারকের বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে সাতটি মামলা ও দুটি জিডি দায়ের হয়। ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ থানায় দুটি মামলা ও দুটি জিডি দায়ের করা হয়। ওই বছরের ২৬শে আগস্ট এসআই দেবাশীষ শর্মা বাদী হয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে তবারকসহ ৩ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় বিশ্বনাথ-লামাকাজী সড়কের আমজদ উল্লাহ কলেজের সামনে থেকে আধা কেজি গাঁজাসহ তার স্ত্রী সাবিনা আক্তারের মালিকানাধীন সিএনজিচালিত অটোরিকশা জব্দ করে পুলিশ। পরে একই বছরের ২৪শে অক্টোবর তবারককে অভিযুক্ত করে থানা পুলিশ সেই মামলার চার্জশিট আদালতে প্রেরণ করে। ওই বছরেরই ১৬ই অক্টোবর সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তবারক আলীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে রামপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ এলাকার ৩ শতাধিক ব্যক্তি স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি প্রদান করেন। এলাকাবাসীর দেয়া স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর দেয়ায় পাঠাকইন গ্রামের ময়না মিয়ার পুত্র চুনু মিয়ার ওপর হামলা করে তার তবারকের পক্ষের লোকজন। এ ঘটনায় চুনু মিয়া বাদী হয়ে তবারকসহ ৭ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- অবৈধ পথে অর্জন করা টাকা দিয়ে বিশ্বনাথে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে তবারক। নামে-বেনামে করা এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ৫০ একর জমি, ৫টি হাইয়েস, ৩টি নোহা, ৩টি এলিয়েন কার, ৩টি বাস, ২টি ট্রাক, ১৬টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ৭টি দোকানকোঠা।