
এখনো সন্তানরা তাদের বাবাকে খুঁজে। রাত হলেই মুখ লুকিয়ে কাঁদে। কী বলে তাদের সান্ত্বনা দেবো? তাকে ছাড়া এই একটা বছর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। স্বামী হারানোর ক্ষত নিয়ে সন্তানদের আঁকড়ে বেঁচে আছি। সন্তানদের নিয়ে কীভাবে কাটাবো বাকি জীবন। এত অল্প বয়সে আমার বাচ্চাদের বাবাহারা হতে হয়েছে। সন্তানদের নিয়ে আমার সামনে কঠিন পথ দেখতে পাচ্ছি। কাঁদতে কাঁদতে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন- ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে শহীদ হওয়া সৈয়দ মোস্তফা কামাল রাজুর স্ত্রী আকলিমা আক্তার। গত ২০শে জুলাই বিকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন রাজু। ২২শে জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। বছর ঘুরে এলেও স্ত্রী-সন্তানদের চোখে-মুখে এখনো কাটেনি শোকের ছায়া। রাজুর স্ত্রী আকলিমা মানবজমিনকে বলেন, আমার সন্তানরা একদম ভেঙে পড়েছে। নিজের কষ্ট বুঝতে না দিয়ে আমি ওদের হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করি সবসময়। আমার স্বামী সবসময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এমন ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটবে কখনো বুঝতে পারিনি। দেশে থেকে সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিলো- সেজন্য বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করেছিল। গত বছরের ২৪শে জুলাই তার সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আর যাওয়া হয়নি। আমার সুখের সংসারটি শেষ হয়ে গেল। বড় মেয়ে আয়েশার ১৩ বছর বয়স। ছোট ছেলেটার বয়স ৫ বছর। বড় দুই সন্তান মাদ্রাসায় পড়ে। আমাদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ। সিদ্ধিরগঞ্জে একটি গাড়ির গ্যারেজ ছিল। এখানেই একটি ভাড়া বাসায় থাকি। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল আমার স্বামী।
তিনি আরও বলেন, ওদের বাবা নেই এক বছর হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সবসময় মনে হয় সে সামনেই আছে। আমি ছেলেমেয়েদের সামনে অনেক ভালো থাকার চেষ্টা করি; কিন্তু আমার ভেতরের ক্ষত কাউকে বুঝতে দেই না। রাত-দিনে চোখে কোনো ঘুম নেই আমার। না ঘুমাতে ঘুমাতে ও দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে, কীভাবে তাদের আমি একা মানুষ করবো এসব চিন্তা সারাক্ষণ আমাকে ঘিরে থাকে। আমার সন্তানদের লুকিয়ে কাঁদতে দেখলে তাদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাই না। প্রত্যেক রাতে আমার মেয়ে ওর বাবার জন্য কান্না করে। দুইটা ঈদ গেল সন্তানদের কারও মুখে হাসি দেখিনি। ওদের হাসি কেড়ে নিয়েছে।
আকলিমা বলেন, আমরা হয়তো বেঁচে আছি, কিন্তু আমি এবং আমার সন্তানরা কেউ ভালো নেই তাকে হারিয়ে। বেঁচে থাকার জন্য তো খাবার-বাসস্থানসহ অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। নগদ অর্থ ও দশ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি। কিন্তু আমি এই টাকা দিয়ে কতোদিন চলতে পারবো। আমি সবসময় সবাইকে বলি নগদ অর্থের চেয়ে আমার একটা চাকরি জরুরি। সন্তানদের তো পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। ওরা দিন দিন বড় হচ্ছে, পড়াশোনাসহ সব ধরনের খরচ বাড়ছে। আমার সন্তানদের নিয়ে কীভাবে চলবো, কোনদিকে যাবো- এটি এখনো জানা নেই। আমাকে যেন একটা চাকরির সুযোগ করে দেয়া হয়। অবুঝ সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সবার কাছে আমার এই একটাই চাওয়া। তিনি বলেন, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। ২০১১ সালে হেলথে চাকরি হয় আমার কিন্তু তখন আমার স্বামী প্রয়োজন মনে করেনি। তার একার আয়ে সংসার চলছে। এখন বুঝতে পারছি আমার চাকরি কতোটা দরকার সন্তানদের জন্য। তিনটা সন্তানই এখনো ছোট। আগের বাসাটায় এখনো ভাড়া আছি; তবে একরুম সাবলেট দিয়েছি। মাঝে মাঝে বাসায় বসে কিছু পোশাক বিক্রি করি। আমি কাজ করে আমার সন্তানদের মানুষ করতে চাই।