
কোনো সিটি করপোরেশনের মেয়র বড়, নাকি একজন মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য বড়? এই প্রশ্নের উত্তর একেক শহরের জন্য একেক রকম। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বেলায় মেয়র বড়। তাই, সুযোগ পেলে মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের বদলে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হতে চান রাজনীতিবিদরা।
তবে প্রস্তাব পেয়েও এমন সুযোগ দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী। তাও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার সুযোগ। রাজধানী ঢাকার মেয়র করার জন্য ডাকসাইটে কোনো নেতা না পাওয়ায় মনের দুঃখে সিটি করপোরেশনই ভেঙে দুই টুকরা করে ফেলেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকা সিটি করপোরেশন গঠনের পর কাউন্সিলরদের ভোটে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে মেয়র হন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ। আর ২০০২ সালে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা।
২০০৭ সালে স্বাভাবিক মেয়াদ পাঁচ বছর পার হলেও তখনকার সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঢাকা সিটির আর নির্বাচন দেয়নি। ফলে এক নির্বাচনেই লম্বা মেয়াদ পেয়ে যান খোকা।
২০০৯ সাল, সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় এসেই ডাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা চিন্তা করে সরকার। এ জন্য নিজ দলের প্রার্থী খুঁজতে থাকেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দায়িত্বরত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা মহানগর বিএনপির সভাপতি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবেও প্রথমে আসে দলের মহানগর শাখার প্রভাবশালী নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নাম। কিন্তু পুরান ঢাকায় মায়ার কোনো জনপ্রিয়তাই ছিল না। আবার মহানগরীর নতুন অংশে ছিল মায়ার ইমেজ সংকট। তাই মোহাম্মদ হানিফের মতো একজন ডাকসাইটে নেতা খুঁজছিলেন শেখ হাসিনা। দলের ভেতরে বিভিন্নজন বিভিন্ন মানুষের নাম বললেও শেখ হাসিনা তাদের কাউকেই পছন্দ করতে পারছিলেন না।
অবশেষে আওয়ামী লীগের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কেন্দ্রীয় নেতা, ইতোমধ্যে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া মতিয়া চৌধুরীকে প্রস্তাব দেন শেখ হাসিনা।
অন্য কেউ এমন প্রস্তাব পেলে যেখানে লুফে নিতেন, সেখানে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে সময় নেন মতিয়া চৌধুরী। পরামর্শ করেন নিজের ঘনিষ্ঠদজনদের সাথে। তাদের প্রায় সবাই মতিয়া চৌধুরীকে ঢাকার মেয়রের দায়িত্ব নিতে নিরুৎসাহিত করেন। কারণ কী?
তারা বলেন, সিটি করপারেশনের ঠিকাদারি, বাসস্ট্যান্ড, ট্রাকস্ট্যান্ড, টেম্পুস্ট্যান্ড সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে মহানগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন সারির নেতা। সিটি করপোরেশনের মার্কেটগুলোতেও তাদেরই প্রভাব।
আর এসব নেতার বেশির ভাগেরই গডফাদার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শেখ সেলিম। তাই সিটি করপোরেশনে ভালো কিছু করতে গেলে নিজ দলের এসব নেতার বিরোধিতা আসবে। তাই জটিল ঢাকা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে মতিয়া চৌধুরীকে নাজেহাল হতে হবে।
ঘনিষ্ঠজনদের এই পরামর্শ মেনে মেয়র হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন মতিয়া চৌধুরী। মন্ত্রণালয় চালানোতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন তিনি।
মতিয়া চৌধুরী মেয়র হতে রাজি না হওয়ায় ভিন্নরকম চিন্তা শুরু করেন শেখ হাসিনা। সিটি করপোরেশনটাকেই দুই ভাগ করে ফেলতে হবে। তাহলে আর বিশাল আকারের অবিভক্ত সিটি করপোরেশন চালানোর মতো বড় নেতা খুঁজতে হবে না। মাঝারি পর্যায়ের লোকজন দিয়েই হয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর সেই ভাবনা থেকেই ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই টুকরা করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা।
অবশেষে ২০১১ সালে সংসদে বিল পাসের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করে মেয়র হন প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন। আর উত্তরে মেয়র হন তখনকার সেনাপ্রধানের ভাই, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যমের পরিচিত মুখ আনিসুল হক।
(ঢাকাটাইমস