Image description
রক্তরঞ্জিত জুলাই-১

গেল বছরের মধ্য সময়। হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠে ঢাকা। কোটা আন্দোলনে জুন মাসে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। সময়ের সাথে জোরদার হয় আন্দোলন। এরই মধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পলাতক স্বৈরাচার হাসিনার একটি মন্তব্যকে ঘিরে বদলে যায় দৃশ্যপট। জুলাইয়ের শুরুতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী হতে শুরু করলে তা দমনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ ও ছাত্রলীগ। ১ জুলাই শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু। এ রকম একটি কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের মতো জনবিদ্রোহে রূপ নেবে মানুষ তা কল্পনাও করেনি।

যদিও এর আগে ২৪ সালের ৫ জুন আদালতে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন থেকেই প্রতিবাদে ফেটে পড়েন সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিল, হলে হলে গিয়ে কোটা সংস্কারের পক্ষে প্রচারণাসহ বেশ কিছু কাজ করতে থাকেন তারা। ঈদের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব প্রতিবাদ হয় তাতে সরকারকে দাবি মেনে নিতে বলা এবং ঈদের পরেও দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলনের ইঙ্গিত দেয়া হয়। সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি কর্ণপাত না করায় আন্দোলন পুনরায় তীব্র হতে থাকে। এরপর ঈদুল আজহার ছুটি শেষ হলে আন্দোলন পুনরায় দানা বাঁধতে শুরু করে। বেশ কয়েকটি ছোট কর্মসূচির পর বেশ সংগঠিত হয়েই সামনে এগোনোর পরিকল্পনা নেয় কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা। এভাবে করে জুন শেষে জুলাই আসে। জুলাই এর প্রথম দিন ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে দেয়া প্রজ্ঞাপন হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণার প্রতিবাদে ও প্রজ্ঞাপন পুনর্বহালের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্র সমাবেশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ওই দিন ছিল সোমবার। সেদিন সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়। মিছিলটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, ক্যাম্পাস শ্যাডো, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ হয়ে হলপাড়ায় যায়। সেখান থেকে হাজী মুহম্মদ মুহসিন হলের সামনে হয়ে ভিসি চত্বর দিয়ে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়। সেদিনের মিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘কোটা না মেধা-মেধা মেধা’, আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আঠারোর পরিপত্র-পুনর্বহাল করতে হবে’, ‘কোটাপ্রথা নিপাত যাক-মেধাবীরা মুক্তি পাক’, ‘সারা বাংলায় খবর দে-কোটাপ্রথার কবর দে’, ‘আমার সোনার বাংলায়-বৈষম্যের ঠাই নাই’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।

ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস থাকায় এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সরকার কর্তৃক ঘোষিত সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতি থাকায় কোনো ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি বন্ধ ছিল সব প্রকার দাফতরিক কার্যক্রমও। ফলে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত অচল ছিল। অনুষদ ও ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তেমন উপস্থিতিও ছিল না। তার আগের রাতেই এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলো স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতর। তৎকালীন ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা তাদের দাবির বিষয়ে সরকারের কোনো পর্যায় থেকে কোনো আশ্বাস না পাওয়ায় কর্মসূচি চলমান রাখার ঘোষণা দেন।

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, একই সাথে প্রত্যায় স্কিম বাতিলের দাবিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনও সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ায় কার্যত সব বিশ্ববিদ্যালয়েই অচলাবস্থা চলমান ছিল। ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিল।

১ জুলাই এর ছাত্র সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংহতি জানিয়ে অংশগ্রহণ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী। জবি শিক্ষার্থী মেহেরুন্নেসা হিমু সমাবেশে বলেন, আমরা যখন কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি তখন আমাদের বলা হয়, আমরা পিছিয়ে পড়াদের অধিকার বিনষ্ট করছি। পিছিয়ে পরা মানুষ কাদেরকে বলে? বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ, লক্ষ লক্ষ পরিবার আছে যারা মাত্র ২০ হাজার টাকা আয়ের ওপরে পুরো পরিবার চালায়। আর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো শুধুমাত্র সম্মানী ভাতাই ২০ হাজার টাকা পান। আর তাদের পরিবারে যারা উপার্জন করতে সক্ষম তাদের কথাগুলো আমরা বাদই রাখছি। সেই পরিবারগুলোকে আমরা কিভাবে পিছিয়ে পড়া বলতে পারি? তারা বলে বেড়ায়, তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আমলে নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তারা বলে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় শুভাকাক্সক্ষী আর কেউ না। তাহলে চতুর্থবারের মতো যেখানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়, সেখানে আজো মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার আদায় হয়নি এটি একটি চরম প্রহসনমূলক কথা।

সমাবেশে অন্য শিক্ষার্থীরা বলেন, আজকে পোষ্যকোটা চালু করা হয়েছে। এটা কাদের পক্ষে? যারা ইতোমধ্যে একটা সরকারি চাকরি করে তাদের ছেলেমেয়েদের পক্ষে। আর কাদের বিরুদ্ধে? যে কৃষক পরিবারের সন্তান, যেই কৃষক হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে তার সন্তানকে পড়াশোনা করায় তার বিরুদ্ধে। জেলে, মজুর, কৃষক, রিকশাওয়ালা যে ভাইবোন রয়েছে তাদের সন্তানেরা যারা পড়াশোনা করছে তাদের বিরুদ্ধে। তাই আমাদের দাবি হচ্ছে, আঠারো সালের পরিপত্রটি সবার আগে বহাল করতে হবে।

সেদিন বিক্ষোভের শেষে শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে চারটি দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো ছিল- ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে; ১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে; সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

দাবি উত্থাপনের পর শিক্ষার্থীরা পুনরায় মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমানের কাছে যান। এ সময় তারা প্রক্টরের কাছে সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি খোলা রাখা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে হল, ক্যান্টিন খোলা রাখাসহ সব শিক্ষার্থী সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানান। একই সাথে তারা পরের দিন তথা মঙ্গলবার (২ জুলাই) দুপুর আড়াইটায় গণ-পদযাত্রা কর্মসূচির ঘোষণা দেন।

তবে এর মূল সূচনা ঘটে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করার রায়ের পর। সরকার ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলার জন্য ১০ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়।