
পতিত সরকারের শেষ বছরের প্রতি মাসেই গড়ে দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম ছিল। দেদারছে অর্থ পাচারের কারণে প্রতি মাসেই এভাবে রিজার্ভ কমে যেতো। পাশাপাশি আদানি, জ্বালানি তেলের বিলসহ বৈদেশিক মুদ্রার দায়ও পরিশোধ করতে পারেনি। এমনিভাবে পতিত সরকারের রেখে যাওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ প্রায় চার বিলিয়ন ডলারসহ গত ১০ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার দায় পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার। এর পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। স্থিতিশীল রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারও। অর্থ পাচার বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ ও হুন্ডি প্রতিরোধে শক্ত অবস্থানের ফলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে এ সুফল এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে এক পর্যায়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে প্রতি মাসেই রিজার্ভ এক থেকে দেড় বিলিয়ন করে কমতে থাকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় নেয়ার শেষ বছরে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ এক পর্যায়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে দেখা দেয় অস্থিতিশীলতা। এক পর্যায়ে ৭৫ টাকার ডলার উঠে যায় ১২৮ টাকায়। আমদানির নামে দেদারছে অর্থ পাচার, রফতানির আয়ের একটি অংশ দেশে না এনে বিদেশে পাচার করা, রেমিট্যান্সের অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডি হওয়া এসব ছিল পতিত সরকারের আমলে নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়। দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে পানির মতো অর্থ বের করে নেয়া হয় রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে। ঋণের নামে এসব অর্থ বের করে বিদেশে পাচার করা হয়। ফলে এক পর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রার দায় পরিশোধ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। প্রতিবেশী দেশ থেকে অসম চুক্তির মাধ্যমে উচ্চ মূল্যে যে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় তার দায় বকেয়া রাখা হয়। বিদেশী এয়ার লাইন্সগুলো তাদের টিকিট বিক্রির অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় নিতে পারছিল না ডলার সঙ্কটের কারণে। বিপিসি’র জ্বালানি তেল, এলএনজি আমদানির দায় পরিশোধ করতে না পারায় এসব অর্থ বকেয়া রাখা হয়। ব্যাংকগুলো এলসির দায় পরিশোধ করতে না পারায় তা বকেয়া রাখা হয়। এভাবে এক দিকে অর্থ পাচার বেড়ে যায়, পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার বকেয়া দায় বাড়তে থাকে। এরই মাঝে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পতিত প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। এভাবেই পতিত সরকারের বিদায় নিলেও মেয়াদোত্তীর্ণ দায় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এক দিকে নিয়মিত দায়, অপর দিকে মেয়াদোত্তীর্ণ দায় পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর প্রথমেই বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা দেশ থেকে টাকা পাচার করেছিল তাদের বেশির ভাগই দেশ থেকে পালিয়ে যায়। যারা ছিল তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়। পাশাপাশি পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপিসহ টাকা পাচারকারীদের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। বিদেশে পাচারের অর্থ শনাক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর ফলে রাতারাতি সুফল পাওয়া যায়। আগে যেখানে প্রতি মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার কমে যেত, সেখানে প্রতি মাসেই এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার যোগ হতে থাকে রিজার্ভে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ৫ আগস্টের পর গত ১০ মাসে পতিত সরকারের রেখে যাওয়া চার বিলিয়ন ডলারের ওপর মেয়াদোত্তীর্ণ দায় পরিশোধ করা হয়। একই সাথে নিয়মিত দায় পরিশোধ করা হয় আরো প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। এরপরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গতকাল ৩০ জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হুন্ডি প্রতিরোধেও কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়। এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যায়। শেষ চার মাসে প্রতি মাসেই ৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি রেমিট্যান্স আসে। আর এ সুবাদে বিদায়ী অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। একদিকে অর্থ পাচার বন্ধ, অপর দিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়তে সহায়ক হয়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, যেভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গেছে, আর এর বিপরীতে টাকা পাচার বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ অব্যাহত রাখলে নতুন অর্থবছরে তা আবারো ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে চলে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্তি করা হয়েছে।