
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিজ্ঞপ্তি দেখে নিজের নামে বিশেষ কোটায় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লটের আবেদন করেন। রাজউক কর্তৃপক্ষ সে আবেদন গ্রহণ করে প্লট বরাদ্দও দেয়। তবে নিয়মমাফিক দেননি কোনো কিস্তি। অবসরের পরে কিস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চিঠি দেন। তবে তা গ্রহণ না করে প্লট বরাদ্দ স্থগিত রাখে রাজউক। এর পাঁচ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সেই প্লট বরাদ্দের জন্য ফের আবেদন করেন। তবে এবার আর রাজউক খালি হাতে ফেরায়নি। মাত্র সাড়ে ছয় লাখ টাকার এক কিস্তি পরিশোধের মাধ্যমে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার একটি প্লট বাগিয়ে নেন। কোনো ধরনের নিয়ম-কানুন না মেনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি প্রকল্পের প্লট নেওয়া ওই ব্যক্তি সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। সুবিচার নিশ্চিত করা যার দায়িত্ব তার বিরুদ্ধেই উঠেছে এমন গুরুতর অভিযোগ। এর প্রাথমিক সত্যতাও পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন খুব শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে এই অনিয়মের অনুসন্ধান শুরু করবে বলে দুদকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৮-৯৯ সালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় রাজউক। এরপর সেখানে বিচারপতি কোটায় নিজের জন্য একটি প্লট বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেন সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। আবেদনটি পর্যালোচনা করে তাকে প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রাজউক। এরপর ২০০৩ সালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে বিচারপতি কোটায় ১০ কাঠা আয়তনের প্লট বরাদ্দ পান খায়রুল হক। ২০০৪ সালের ২১ জানুয়ারি তার অনুকূলে সাময়িক বরাদ্দপত্র জারি করা হয়। এ সংক্রান্ত চিঠিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রথম কিস্তির সাড়ে ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। তবে চিঠি পেয়ে নির্ধারিত সময়ে কোনো কিস্তি পরিশোধ করেননি তিনি। এরপর ২০০৪ সালের ১৭ মে অবসরের পরে কিস্তি পরিশোধ করার সুযোগ চেয়ে রাজউকে আবেদন করেন। বিচারপতির সেই আবেদন নিয়ে রাজউকের ০৭/২০০৪তম সাধারণ সভায় আলোচনা হয়। সভায় বিচারপতির আবেদন বাতিলের সিদ্ধান্ত আসে। এরপর তাকে ফের চিঠি দিয়ে ‘আবেদন বিবেচনার অবকাশ নেই’ বলে জানানো হয়। এর পরও তিনি একই বছরের ১৫ জুলাই প্রথম কিস্তি পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কিস্তির ওই টাকা পরিশোধ করেননি। নির্ধারিত সময়ে কিস্তি পরিশোধ না করায় প্লটটির বরাদ্দ স্থগিত হয়ে যায়। একই সঙ্গে বাতিলের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ২০০৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর খায়রুল হক ফের প্লটটি তার নামে বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেন। এ সংক্রান্ত চিঠিতে তিনি জানান, তার নামে বরাদ্দকৃত প্লট রাজউক বাতিল করেছে এবং বরাদ্দকৃত প্লটের বাতিলাদেশ প্রত্যাহার পূর্বক বরাদ্দ রেস্টোর (পুনর্বহাল) করার জন্য অনুরোধ জানান। যদিও রাজউক প্লটটির বরাদ্দ বাতিল করেনি, এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো চিঠিও তাকে দেয়নি। এবারও তার আবেদনটি আমলে নিয়ে রাজউক বিগত সময়ের বকেয়া কিস্তি সুদসহ পরিশোধের শর্তে তাকে ফের প্লটটি বরাদ্দ দেওয়া হবে জানিয়ে একটি চিঠি দেয়। এবার বিচারপতি সুদসহ পুরো টাকা না দিয়ে প্রথম কিস্তির সাড়ে ছয় লাখ টাকা বাবদ সোনালী ব্যাংক, সুপ্রিম কোর্ট শাখার একটি চেক দেন। তবে সুদ ছাড়া চেকটি নগদায়ন না করে রাজউক মন্ত্রণালয়ে পাঠায় মতামতের জন্য।
এরপর মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে উল্টো রাজউকের কর্মকর্তাদেরই ধমকানো হয়। মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, রাজউক বিচারপতির চেক যথাসময়ে নগদায়ন না করে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, রাজউক কেন বিচারপতির পত্রের জবাব যথাসময়ে প্রদান করে স্বীয় অবস্থান পরিষ্কার করেনি এবং চেক নগদায়ন না করে আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছে; তজ্জন্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে; বিষয়টি যেহেতু সুদ মওকুফের নয়, সুদের প্রযোজ্যতা সংক্রান্ত, সেহেতু রাজউক নিজস্ব বিধিবিধানের আওতায় যুক্তিসংগতভাবে যাবতীয় দেনা-পাওনা নির্ধারণ করে প্লটের বরাদ্দ প্রাপক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে অবহিত করবে। এরপর ২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জনতা ব্যাংক, রাজউক শাখায় চেকটি নগদায়নের জন্য জমা দেওয়া হয়। পরে বাকি টাকা না দিয়ে বিচারপতি ফের অবসরের পরে সুদ ছাড়া বাকি টাকা পরিশোধের আবেদন জানিয়ে রাজউকে চিঠি দেন। পরবর্তী সময়ে বিচারপতি খায়রুল হকের অনুকূলে যাবতীয় দেনা-পাওনা অবসরগ্রহণের পরে পরিশোধের শর্তে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক মহাপরিচালক কালবেলাকে বলেন, ‘সাবেক বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আইন না মেনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজউকের প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন, যা তিনি পারেন না। এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ দুদকের কাছে এসেছে। এ বিষয়ে শিগগির প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরু করবে দুদক।’