Image description

হোয়াইট হাউজে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার আগে গাজা উপত্যকায় নারকীয় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। গাজার বিভিন্ন স্থানে হামলায় অন্তত ৮০ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়েও নিহত হয়েছে ১৫ জন। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। গতকাল একই সঙ্গে হাসপাতাল, স্কুল ও বাসভবনে হামলা হয়েছে। শত শত পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং হাসপাতালেও চিকিত্সা পাচ্ছেন না আহতরা।

গাজায় যেন হঠাত্ ভূমিকম্প

গাজায় রবিবার দিবাগত রাতটা যেন বাসিন্দাদের জন্য ভূমিকম্পের রাত ছিল। ইসরাইলি বিমান হামলা তাদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। এই হামলা এমন সময় হলো যখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য হোয়াইট হাউজে যাচ্ছেন। এই আলোচনায় গাজার পাশাপাশি ইরানও স্থান পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ মাস ধরে চলমান যুদ্ধের অবসানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। অথচ তারপরই বড় ধরনের হামলা চালাল ইসরাইল। গাজা সিটির পাঁচ সন্তানের জনক ৬০ বছর বয়সি সালাহ বলেন, বিস্ফোরণ কখনো থামেনি। তারা স্কুল এবং বাড়িঘরে বোমাবর্ষণ করেছে। ভূমিকম্পের মতো অনুভূত হয়েছিল। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধবিরতি হবে বলে খবর শুনতে পাচ্ছি। অথচ আমরা মৃত্যুই দেখতে পাচ্ছি। চারদিকে কেবলই বিস্ফোরণের শব্দ।

ইসরাইলি ট্যাংকগুলো গাজা উপত্যকার জেইতুন শহরতলির পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে এবং উত্তরের বেশ কয়েকটি এলাকায় গোলাবর্ষণ করে। অন্যদিকে বিমানগুলো কমপক্ষে চারটি স্কুলে বোমাবর্ষণ করে। শত শত পরিবারকে সেখান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয় বলে বাসিন্দারা জানিয়েছেন। গতকাল ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৮০ জন নিহত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এর মধ্যে উত্তর গাজায় ৫৭ জন এবং গাজা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছে। চিকিত্সকরা জানিয়েছেন যে, ১৩ জনের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তবে বাসিন্দারা বিমান হামলার খবরও জানিয়েছেন। রাফাহ এবং দক্ষিণ গাজায় ইসরাইলি হামলায় ত্রাণ নিতে গিয়ে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছে।

ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে যে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার পর উত্তর গাজায় জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তুতে, কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। উত্তরের বিস্তীর্ণ এলাকায় নতুন করে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশের পর ভারী বোমাবর্ষণ হয়েছে, যেখানে ইসরাইলি বাহিনী আগে অভিযান চালিয়েছিল এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। সেনাবাহিনী সেখানকার লোকজনকে দক্ষিণে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, বলেছে যে তারা গাজা শহরের কেন্দ্রস্থলসহ উত্তর গাজায় কর্মরত হামাস জঙ্গিদের          

বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করছে। গাজার প্রশাসন জানিয়েছে, এরই মধ্যে অঞ্চলটির টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার ৭৪ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৫৬ হাজার ৬৩৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এদিকে গতকাল পবিত্র আল-আকসা মসজিদে হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি সেটলাররা।

যুদ্ধবিরতির পর গত মার্চে আবারও গাজায় হামলা শুরু করে ইসরাইল। গাজা শহরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ইসরাইলি বাহিনী শহরের ঘনবসতিপূর্ণ পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকায়, বিশেষ করে শুজাইয়া, তুফাহ এবং জাইতুনসহ ঘনবসতিপূর্ণ পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, রাতের আকাশ জুড়ে বিস্ফোরণের আলো, আতঙ্কিত হয়ে গাজার বাসিন্দাদের ছুটোছুটি করা, বিস্ফোরণের পর কোথাও কোথাও আগুনও জ্বলতে দেখা গেছে। গাজার জাইতুন এলাকায় একটি স্কুলে হামলার খবর পাওয়া গেছে। যেখানে বাস্তুচ্যুত অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। জাইতুন এলাকা থেকে সাত সন্তানের মা আবেয়ার তালবা বলেন, সবকিছু ফেলে চলে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

ক্রীড়াবিদ ও সাংবাদিকের প্রাণহানি

গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় ৭৮৫ জন ফিলিস্তিনি ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। রবিবার তুরস্কভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আনাদোলুকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে সংগঠনটির উপপ্রধান সুসান শালাবি জানান, নিহতদের মধ্যে বিভিন্ন ক্রীড়া শাখার খেলোয়াড় ও প্রশাসনিক কর্মীরা রয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই গাজায় এবং অন্তত ২৩ জন নিহত হয়েছেন অধিকৃত পশ্চিম তীরে। শালাবি বলেন, নিহতদের মধ্যে ৪৩৭ জনই ফুটবল খেলোয়াড়, যার মধ্যে পশ্চিম তীরের ১৫ জন ছিলেন। শালাবি জানান, ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় এখন পর্যন্ত ২৮৮টি ক্রীড়া স্থাপনা আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম ও ক্লাব ভবন। এসবের মধ্যে ২১টি স্থাপনা পশ্চিম তীর এলাকায় অবস্থিত। গাজায় ইসরাইলি হামলায় সাংবাদিক নিহতের সংখ্যা আড়াই শ ছাড়িয়েছে।

৮৮০ ইসরাইলি সেনা নিহত

গাজা উপত্যকা জুড়ে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া চলমান যুদ্ধে ৮৮০ ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে নিহত সেনাদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। টাইমস অব ইসরাইল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নিহত সেনাদের মধ্যে ৩২৯ জন ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা সীমান্তে হামাসের আক্রমণের সময় এবং কমপক্ষে ৪৩৬ জন হামাস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে স্থল আক্রমণ ও সীমান্তে অভিযানের সময় নিহত হন।

যুদ্ধবিরতির চেষ্টা

চলমান এই হত্যাযজ্ঞ থামাতে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা চলছে বলে জানায় মিশর। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, কয়েক জন ইসরাইলি বন্দি হস্তান্তরের বিনিময়ে গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি ও দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করছে তারা। মিশর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলমান এই পরিকল্পনাকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পথে ‘প্রথম পদক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। এদিকে স্থানীয় সময় সোমবার (গতকাল) ওয়াশিংটন সফরে যাচ্ছেন ইসরাইলের স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্স মিনিস্টার রন ডার্মার। হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তার বরাতে ইসরাইলি গণমাধ্যম জানায়, গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করে বন্দিদের ফিরিয়ে দিতে তার ওপর চাপ দিতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগেই একটি চুক্তি চূড়ান্ত করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন।