Image description

সুন্দরবনে থামছে না হরিণ শিকার। বর্তমানে চোরা শিকারিদের কাছে হরিণ শিকার ও পাচার নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। জুন থেকে আগস্ট তিন মাস সুন্দরবনে জেলে-বাওয়ালীসহ পর্যাটকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও থামছে না হরিণ শিকারিদের তৎপরতা। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গড়ে উঠেছে একাধিক হরিণ শিকারি চক্র। এই চক্র শিকার করা হরিণের মাংস স্থানীয়ভাবে বিক্রি করছে, এমনকি হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও চালু করেছে। বনবিভাগ ও কোস্ট গার্ডের অভিযান এবং পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও থামানো যাচ্ছে না এই অবৈধ কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতে হরিণ শিকার রুখতে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কমিটি গঠনসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে বনবিভাগ।
কোস্ট গার্ড ও বনবিভাগের অভিযানে গত ৬ মাসে সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬শ’ কেজি হরিণের মাংস, ৮টি হরিণের চামড়া ও ৪শ’টি হরিণ শিকারের ফাঁদসহ ২০ জন হরিণ শিকারিকে আটক করেছে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের সদস্যরা। এ ছাড়া গত ১ মাসে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে ২ হাজার ৬১৫টি হরিণ শিকারের ফাঁদ। এ সময় হরিণ ও বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নানা অপরাধে ১২ জন শিকারিকে আটক করার পাশাপাশি ১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে হরিণের মাংসসহ আটক করা হয় ৫ জনকে।

জানা গেছে,  সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় জেলে-বাওয়ালিদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে হরিণ শিকারিরা। সুন্দরবনে মাছ ধরার পাস পারমিট নিয়ে প্রবেশ করা জেলে বা বাওয়ালিরা সুযোগ পেলে হরিণ শিকার করে। এ ছাড়া একাধিক বড় চক্র রয়েছে যারা সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় নিয়মিত হরিণ শিকার করে। ওরাই মূলত মূল শিকারি, ওরা হরিণ শিকার করে বিক্রি করে আবার চাহিদা অনুযোয়ী বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়। এ ছাড়া ঈদ, কোরবানিসহ বিশেষ দিন উপলক্ষে সুুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে হরিণের মাংসের চাহিদা বাড়ে, তখন স্থানীয়দের পাশাপাশি প্রশাসনের লোকজনও হরিণের মাংস খায়। 

শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, এই এলাকার এক শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি হরিণ শিকারি চক্রের সঙ্গে জড়িত থেকে অনেক সময় হরিণের মাংস বিক্রি করেন। এ ছাড়া উপজেলা রাজাপুর এলাকার হরিণ শিকারি একচক্র রায়েন্দা বাজার, মোরেলগঞ্জ ও বাগেরহাট এলাকায় গোপনে মাংস বিক্রি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। চাহিদাভেদে ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা কেজিতে হরিণের মাংস বিক্রি করে বলে জানা গেছে। শিকারিদের সূত্রে আরও জানা গেছে,  সুন্দরবনে সব থেকে বেশি হরিণ শিকার করা হয় দুবলার চর, আলোর কোল, কবরখালী, মানিকখালী, কালামিয়ার ভারানী, হিরণ পয়েন্ট, কটকা, কঁচিখালি, চান্দেরশ্বর, চরখালি ও পোড়া কোরালিয়া এলাকা থেকে। এসব এলাকায় হরিণের চলাচলের পথে নাইলনের সুতার ফাঁদ, স্প্রিং বসানো ফাঁদ, কলার সঙ্গে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে ও গুলি ছুড়ে হরিণ শিকার করা হয়।

সুন্দরবন সংলগ্ন প্রায় সব এলাকায় কমবেশি হরিণের মাংস পাওয়া যায়। এসব গ্রামগুলোতে গরু ও খাসির মাংসের তুলনায় হরিণের মাংস কম দামে পাওয়া যায়। সর্বশেষ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্যা কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) এর ২০২৩ সালের জরিপের তথ্য মতে, বর্তমানে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজারটি। সেই হিসেবে ১৯ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে হরিণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬০৪টি। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন,  শিকারিদের ধরতে বর্তমানে বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তাসহ বনরক্ষীরা ব্যাপক তৎপর রয়েছে। ইতিমধ্যে জ্ঞান পাড়ার হরিণ চক্রের হোতা জাকির বিশ্বাস ও চরদুয়ানীর মালেক জমদ্দারকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে বনবিভাগ। এরই মধ্যে হরিণ শিকার প্রতিরোধে জেলে ও মৌয়ালদের সুন্দরবনে হরিণ শিকারের ফাঁদ ফেলে সেটা উদ্ধার করে জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সমপ্রতি হরিণ শিকারের ফাঁদ উদ্ধারে সহযোগিতা করায় ৮ জনকে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শুধু শিকারি নয়, যারা হরিণের মাংস খান, এমন ভোক্তাদেরও চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।