Image description

দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী শাসনকালে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে আওয়ামী অপরাধীদের বিরুদ্ধে সুবিচার নিশ্চিত করবে। তবে বাস্তব চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। গুম, খুন ও সীমাহীন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত আওয়ামী সন্ত্রাসীদের যেখানে জেলের ঘানি টানার কথা, সেখানে কারাগারের ভেতরেও রাজকীয় জীবনযাপন করছেন তারা। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী ও ভ্রতৃপ্রতিম সংগঠনের শতাধিক নেতা ও দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা কারা অভ্যন্তরেই বিলাসবহুল ও রাজকীয় জীবনযাপন করছেন। কারা কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বন্দিদের জন্য মোটা অঙ্কের বিনিময়ে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এর বিনিময়ে কারাগারের ভেতরে কোটি কোটি টাকার লেনদেন চলছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র। অনেকেই আবার জেল থেকে মুক্তির পর ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন।

অন্যদিকে কারাগারের বাইরে থাকা প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যেই অবাধে চলাফেরা করছেন। এমনকি কারাগারে অল্প কয়েকদিন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ফের নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তির জানান দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন ছাত্র-জনতার উদ্দেশে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ সমর্থিত ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পত্রিকা ও কথিত সাংবাদিক নামধারীরা সরাসরি আওয়ামী নেতাদের সহায়তায় রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচার ও উত্তেজনাকর কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সমন্বয়কারী এবং নেতৃত্বদানকারীদের প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে হত্যার মাধ্যমে দেশে প্রতিবিপ্লবের ডাক দিচ্ছেন।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, ময়মনসিংহে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও হামলায় অভিযুক্ত প্রায় ২৫০ জন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা গত এক মাসে মুক্তি পেয়েছেন। বিষয়টি রহস্যজনক। অথচ ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া অন্যান্য গুরুতর মামলায় তাদের পুনরায় গ্রেপ্তার দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল। মুক্তির পরপরই এসব নেতা প্রকাশ্যে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার, রাষ্ট্র ও গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক প্রচার চালাচ্ছেন। এমনকি যারা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি হামলা ও ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তাদের বেশিরভাগের নামে এখনো কোনো মামলা হয়নি।

এদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশ ও সমালোচনা করায় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও সচেতন নাগরিকদের প্রকাশ্যে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হত্যা ও হামলার হুমকি দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা পুরোনো কৌশল ব্যবহার করে সমালোচকদের বিরুদ্ধে ‘জঙ্গি’ তকমা লাগানোর মাধ্যমেও অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

এসব গুরুতর অভিযোগ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে অবগত করলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো পুলিশ অভিযোগকারীদের সহায়তার পরিবর্তে অভিযুক্ত আওয়ামী নেতাকর্মীদের গোপনে সতর্ক করে দিচ্ছে। পুলিশ আওয়ামী নেতাকর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়ার রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট মুছে ফেলা বা ‘অনলি মি’ করার পরামর্শও দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পুলিশের নির্ভরযোগ্য তথ্যমতে, আওয়ামী সরকারের আমলে ময়মনসিংহ রেঞ্জে কর্মরত ছিলেন এমন বেশিরভাগ কর্মকর্তাই এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে ময়মনসিংহ রেঞ্জেই বহাল আছেন, যে কারণে তারা আওয়ামী নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন। এমনকি পুলিশের গোপন তথ্য ও অভিযানসংক্রান্ত গোয়েন্দা বার্তা অভিযুক্তদের কাছে আগেই ফাঁস করে দিচ্ছেন।

কারাগার থেকে একে একে বের হচ্ছেন আওয়ামী নেতাকর্মীরা

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, গত এক মাসে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে প্রায় ২৫০ জন আওয়ামী নেতাকর্মী ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। যারা বের হয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। এরা বর্তমানে গ্রাম থেকে শুরু করে থানা, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ গোছানোর কাজ করছেন।

পুলিশের বিশেষ ব্রাঞ্চের (এসবি) এক কর্মকর্তা জানান, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ৭৫০ জনের বেশি নেতাকর্মী বন্দি ছিলেন। বর্তমানে গ্রেপ্তারও কম, মামলাও কম। সারা দেশের চিত্র একই। তিনি আরো জানান, আগে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তারা জেলা লেভেলের তেমন কোনো বড় নেতা নন। বড় নেতাদের প্রায় সবাই পলাতক, যে কারণে ছোট নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে বন্দি থাকায় তাদের আওয়ামী সরকারের মতো নতুন কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো যাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো আছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রকাশ্যে ঘোরার অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এখনো নিষিদ্ধ আওয়ামীদের প্রতি প্রীতি পুলিশের

চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেলেও মাঠপর্যায়ের প্রশাসনে দেখা গেছে ভিন্নচিত্র। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে চলছেন। শুধু তাই নয়, পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা আওয়ামীবিরোধী কর্মকর্তাদের নাম হাইকমান্ডের কাছে পাঠাচ্ছেন, তারপর আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে যেসব পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার অভিযানে সক্রিয় ছিল বা রয়েছে, তাদের বদলি করে দিচ্ছে।

জানা গেছে, গত ৩ ও ৪ মে একযোগে ময়মনসিংহের ছয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বদলি করা হয়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এ থানাগুলো গত সাত মাসে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার ও অভিযানে ভূমিকা রাখছিল। কিন্তু বদলির পর এসব থানায় আওয়ামী নেতাদের গ্রেপ্তার নেই বললেই চলে। বরং কারাগার থেকে একের পর এক আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তি পেয়ে এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরছেন।

এর পাশাপাশি আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কিছু ব্যক্তি সাংবাদিকতার ছদ্মবেশে সরকারি অফিসের গোপন তথ্য পাচার করছেন পলাতক আওয়ামী নেতাদের কাছে। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করছেন আওয়ামী সরকারের আমল থেকে ময়মনসিংহে বহাল থাকা কর্মকর্তারা। আর এসব কর্মকর্তা ‘শেখ হাসিনা আবারও ফিরে আসবে’ বলে এখনো বিশ্বাসী।

সমন্বয়কদের হত্যার হুমকি ও প্রতিবিপ্লবের ডাক, তবুও দায়মুক্তি

জুলাই বিপ্লবে ময়মনসিংহে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ সমন্বয়কারীদের ওপর চলমান হুমকি, হামলা ও হয়রানিমূলক প্রচার রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তায় বিপজ্জনক চিত্রই ফুটে উঠেছে। আন্দোলনের সফলতার পর সমন্বয়কদের অনেকেই হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন বলে অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর রাতে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি মোবাইল ফোনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম সমন্বয়ক আশিকুর রহমানকে গলা কেটে হত্যার হুমকি দেন। ওই ঘটনায় ১৯ ডিসেম্বর কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত তদন্তে অগ্রগতি হয়নি। এরপর গত ২০ জানুয়ারি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আরেকজন সমন্বয়ক মোহাইমিনুল ইসলাম ওরফে শিহাবের বাড়ির দেয়ালে লাল রঙে লেখা হয়Ñ‘সমন্বয়ক মরার জন্য প্রস্তুত হ’।

সরাসরি এ ধরনের হত্যার হুমকির পর এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। একই ভাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা শাখার সদস্য আকাশ মিয়াও গত ৭ জানুয়ারি মুঠোফোনে হত্যার হুমকি পান এবং পরদিন থানায় জিডি করেন। আরো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গত ২৬ মে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সদস্য সচিব আল নূর মোহাম্মদ আয়াশকে দিনের বেলায় ছুরিকাঘাত করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তবে এখনো ওই হামলার কোনো ‘ক্লু খুঁজে পায়নি’ পুলিশ।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ২৩ মে কথিত আওয়ামী সাংবাদিক বদরুল আমীন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেন, সমন্বয়কদের ঝুলিয়ে হত্যা করো, এটাই প্রতিবিপ্লব।’ এটি সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহ ও সহিংসতার উসকানি। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হলেও বদরুলকে আজও গ্রেপ্তার করা হয়নি। বরং থানা ও ফাঁড়িতে রাতভর পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে আড্ডা দেন বদরুল। কিছু পুলিশ সদস্য তাকে রক্ষা করতে তৎপর। কারণ বদরুল গত ১৬ বছর ধরে পুলিশের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে অবৈধভাবে আয় করে পুলিশকে ভাগ দিয়েছেন কোটি টাকা।

দুই কোটি টাকার প্রস্তাব ও ডিআইজিকে অপমান

ময়মনসিংহে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার ও প্রশাসনকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চেষ্টার অভিযোগ নতুন মোড় নিচ্ছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর পুলিশের এক উপমহাপরিদর্শককে (ডিআইজি) জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও সাবেক মেয়র ইকরামুল হক টিটুর ভাই ব্যবসায়ী আমিনুল হক শামীম পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে লোক মারফত দুই কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ডিআইজি ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে ‘সমন্বয়ক’ নামধারী ছাত্রলীগ নেতা এবং কিছু কথিত সাংবাদিক ডিআইজির কার্যালয়ে গিয়ে তাকে ঘিরে উচ্চস্বরে হুমকি-ধমক এবং পদত্যাগের দাবিতে চাপ প্রয়োগ করে। ওই ঘটনায় প্রশাসনিকভাবে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

তবে আমিনুল হক শামীমের দাবি, তিনি গত বছরের নভেম্বরে বিদেশ যান এবং ডিসেম্বরে দেশে ফেছেন। তখনও তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ১৫ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিনি আরো বলেন, ওই সময় তার পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আটকে দিয়েছিলেন ওই ডিআইজি।

বিশেষ কর্মকর্তাদের ব্যাপারে চুপ ঊর্ধ্বতনরা

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশ প্রশাসনের উচ্চপদে বড় ধরনের রদবদল হলেও জেলা পুলিশের বেশিরভাগ কর্মকর্তা এখনো ময়মনসিংহ রেঞ্জেই কর্মরত। অথচ তারাই ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও গুলি চালিয়েছিলেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব কর্মকর্তা সরাসরি জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আমিনুল হক শামীমের ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষায় জড়িত। শামীমের মালিকানাধীন ‘শামীম এন্টারপ্রাইজ’ ও তার ছেলে সামিউল হক সাফার বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে এসব কর্মকর্তা কাজ করছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সারা দেশে আওয়ামী লীগের প্রভাব খর্ব হলেও ময়মনসিংহে শামীমের ব্যবসা চলছে দেদার।

অপরদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ময়মনসিংহের থানাগুলোয় উল্লেখযোগ্য কোনো হামলা, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাটের ঘটনা না ঘটলেও ‘সহিংসতা প্রতিরোধের কৃতিত্বে’ পিপিএম পদক পেয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমএম মোহাইমেনুর রশিদ। অথচ তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমিনুল হক শামীমের সুপারিশের ভিত্তিতে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট ময়মনসিংহে যোগ দেন। অভ্যুত্থানের পর তাকে অন্যত্র বদলি করা হলেও অজ্ঞাত কারণে দুবার বদলি ঠেকিয়ে ফিরে আসেন ময়মনসিংহে।

জুলাই আন্দোলনকারী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা জানান, মোহাইমেনুর রশিদ আওয়ামী লীগের আমলে নিজেকে ‘সাবেক ছাত্রলীগ নেতা’ পরিচয় দিতেন এবং গোয়েন্দা পুলিশের নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করতেন। শুধু তাই নয়, ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই রাতে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালিয়ে জামায়াতের প্রভাবশালী ১৯ নেতাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তারে ভূমিকা রাখেন।

ছাত্রদলের নেতা তানভির তাহের সৌরভের অভিযোগ, ২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবর যৌথবাহিনী তাকে আটক করে কোতোয়ালি থানায় পাঠায়। পরে মোহাইমেনুর রশিদের নেতৃত্বে ডিবি অফিসে নিয়ে চোখ বেঁধে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।

এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমএম মোহাইমেনুর রশিদ বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের আমল থেকেই এখানে কর্মরত। আমার ব্যাপারে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জেনে নিন।’

কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আঁতাত ও সিন্ডিকেট

ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার আমিনুল ইসলামের জন্মস্থান ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায়। অন্যদিকে জেলার আতিকুর রহমানের বাড়ি জামালপুরে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে জেলারের রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তিনি প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, শরীফ আহমদ ও ময়মনসিংহ সদরের এমপি মোহিত উর রহমান শান্তর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। ফলে আওয়ামী নেতাকর্মী ও কারা সদস্যদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ সিন্ডিকেটে আরো যুক্ত রয়েছেন কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জন ডা. প্রবীর কুমার, ডা. মিথুন কুমার, ডা. রায়হান, ডিপ্লোমা নার্স আবুল বাশার ও আসাদুজ্জামান। তারা নিয়মিতভাবে আওয়ামী নেতাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশেষ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে মেডিকেলে ভর্তির চুক্তি করেন। সিন্ডিকেট সদস্যরা চুক্তি অনুযায়ী টাকা পাওয়ার পরই আওয়ামী নেতাদের ‘বুকে ব্যথা’ বা ‘হার্ট অ্যাটাক’ দেখিয়ে সাধারণ ওয়ার্ড থেকে মেডিকেলে স্থানান্তর করেন।

তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, কারাগারে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই কারা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় প্রভাবশালী বন্দি হিসেবে বিশেষ সুবিধা ভোগ করছেন। যদিও বাস্তবে তাদের কোনো শারীরিক অসুস্থতা নেই। যেমন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম মিন্টু ও জেলা যুবলীগের সদস্য সৈয়দ সাদিকুল মোমেন তানিম কয়েক মাস কারাগারে রাজকীয় জীবনযাপন শেষে সম্প্রতি মুক্তি পানন। মুক্তি পেয়ে শফিকুল ইসলাম মিন্টু গত কয়েকদিন আগে নিরাপদে ইমিগ্রেশন শেষ করে দেশত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম ওরফে পেট্রোল সাইফুল ও সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আসিফ হোসেন ডনও জামিনে মুক্তি পেয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।

কারাগারে রাজনৈতিক সভা ও হুমকি-ধমকি

বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের প্রায় ২০ জন নেতা ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। এদের মধ্যে রয়েছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গৌরীপুরের সাবেক এমপি নাজিম উদ্দিনের ছেলে তানজীর আহমেদ রাজীব, মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নওশেল আহমেদ অনি, সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান দুলাল, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ও নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ওমর ফারুক সাবাস।

সূত্র জানায়, তারা সারা দিনই রাজনৈতিক মিটিং, আড্ডা ও বিলাসী জীবন পার করছেন। শুধু তাই নয়, সাধারণ হাজতি ও কয়েদিদের হুমকি দিয়ে আওয়ামী লীগের এসব নেতা হাত-পা ম্যাসাজ করিয়ে নিচ্ছেন। কারারক্ষীরা প্রতিবাদ করলে তারা বলেন, ‘তোমাদের জেল সুপার আমাদের বন্ধু, বেশি কথা বললে বদলি করে রাঙামাটি পাঠিয়ে দেব।’

টাকার বিনিময়ে রাতে কারাগার থেকে মুক্তির ব্যবস্থা

ময়ময়নসিংহ কারাগারের জানালা দিয়ে আওয়ামী নেতাদের বিশেষ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে ডেপুটি জেলার সিরাজুস সালেহীন, ইমতিয়াজ জাকারিয়া, আব্দুল কাদির ও রিজার্ভ প্রহরী জুলহাস ও কারারক্ষী আসিফুলের বিরুদ্ধে। প্রতিবার সাক্ষাতে তারা নিচ্ছেন পাঁচ হাজার টাকা। অন্যদিকে জামিনে মুক্ত আসামিকে শ্যোন অ্যারেস্টের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ। আওয়ামী লীগ নেতাদের নিরাপদে কারাগার থেকে বের করে দেওয়ার জন্য নেওয়া হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা করে এবং সুযোগমতো গোপনে বের করে দেওয়ার ঘটনাও অহরহ।