
গাজীপুরে পোশাক কারখানায় এক ইলেকট্রিশিয়ানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মহানগরীর কোনাবাড়ী থানাধীন কাশিমপুর রোডের একটি পোশাক কারখানায় গত শুক্রবার (২৭ জুন) রাত আনুমানিক ৮টা থেকে শনিবার (২৮ জুন) বিকেল সাড়ে ৪টার মধ্যে কোনো এক সময় তাঁর মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, কারখানা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি প্রথমে গোপন করার চেষ্টা করায় ঘটনাটি দেরিতে প্রকাশ পায়।
নিহত ইলেকট্রিশিয়ানের নাম হৃদয় (১৯)। তিনি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার শুকতারবাইদ এলাকার বাসিন্দা আবুল কালামের ছেলে। হৃদয় গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী থানাধীন হারিনাবাড়ী এসরারনগর হাউজিং এলাকায় মিরাজের বাড়িতে মা ও বোনসহ ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি স্থানীয় গ্রিনল্যান্ড ফ্যাক্টরিতে ডাইং সেকশনের ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে অস্থায়ীভাবে কাজ করতেন।
এ ঘটনায় কোনাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহ উদ্দীন।
গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম হাসান মাহমুদ মিঠুন (২৮)। তিনি গ্রিনল্যান্ড ফ্যাক্টরির কর্মচারী বলে জানা গেছে। মিঠুন টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী থানার হাদিরা বাজার এলাকার মফিজ উদ্দিনের ছেলে এবং কোনাবাড়ীর কুদ্দুসনগর এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন।
স্থানীয়রা জানান, ঘটনার খবর আশপাশের অন্য গার্মেন্টসে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে প্রায় ৪০০-৫০০ শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসেন এবং গ্রিনল্যান্ড গার্মেন্টস কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে হৃদয় হত্যার বিচার দাবি করেন। এ সময়ে তাঁরা কয়েক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
স্থানীয়রা আরও জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর কর্তৃপক্ষ গার্মেন্টসের মূল ফটকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নোটিশ ঝুলিয়ে পালিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে কোনাবাড়ী থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘প্রথমে আমাদের কাছে খবর আসে একজন চোর ফ্যাক্টরির দেয়াল টপকে ভেতরে আসার সময় ড্রেনে পড়ে আহত হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, ওই ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। ঘটনার সময় জিএমপি উত্তর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনারসহ আমরা একটি মামলার তদন্তে ছিলাম। এ সময় খবর আসে কয়েক শ শ্রমিক ফ্যাক্টরি ভাঙচুর করছে, আমার দ্রুত সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করি। পরে সেনাবাহিনী ও শিল্প পুলিশ এলে তাদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।’
ওসি সালাউদ্দিন বলেন, ‘স্থানীয়দের কাছ থেকে ঘটনা শোনার পর আমরা কারখানায় অভিযান চালিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ এবং হত্যায় ব্যবহৃত অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আমরা নিশ্চিত হই এটি হত্যাকাণ্ড।’
ওসি আরও বলেন, ‘গত শুক্রবার দিবাগত রাত ২টার পরে কারখানার ভেতরে হৃদয়কে নির্যাতন করার ফুটেজ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাতেই হৃদয় মারা যান। পরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে শনিবারে সকালে অ্যাম্বুলেন্সে করে হৃদয়ের লাশ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে কারখানার সবাই পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা ঘটনা জানতে পেরে বিক্ষোভ করে ও আমরা খবর পাই।’
এদিকে সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, গত শুক্রবার দিবাগত রাতে কিছু লোক হৃদয়কে দড়ি দিয়ে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে কারখানার ভেতরে একটি কক্ষে নিয়ে যাচ্ছে। পরে ওই কক্ষে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। শনিবার সকাল ১০টা ১৪ মিনিটে কারখানা ভেতরে একটি অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে দেখা যায়। হৃদয়কে নিয়ে ১০টা ২১ মিনিটে অ্যাম্বুলেন্সটি কারখানা ত্যাগ করে।
হৃদয় মারা যাওয়ার পর তাঁর একাধিক ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে। ছবিতে দেখা যায়, হাঁটুতে, কোমরে, পিঠে, হাতের কবজিতে, কনুইয়ে এবং হাতের নখে, গলায় ও মুখমণ্ডল রক্তাক্ত ও কালচে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে তাঁকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশ মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে।
কোনাবাড়ী থানার ওসি বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে আমাদের জানানো হয়, হৃদয়কে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। উত্তেজিত শ্রমিকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ওই কারখানায় অভিযান চালাই এবং সিসিটিভির ফুটেজসহ অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আমরা নিশ্চিত হই যে এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় আমরা ফুটেজ দেখে আসামিদের শনাক্ত করি এবং অভিযান চালিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একজনকে গ্রেপ্তার করি। বাকি জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের একাধিক টিম বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে।’
এ ঘটনায় নিহত হৃদয়ের ভাই লিটন মিয়া (৩৭) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কোনাবাড়ী থানায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লাশ গুমের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি শনিবার (২৮ জুন) রাত সাড়ে ১১টায় রুজু করা হয়।