
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিন্যামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাতে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বেশির ভাগ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। দরপত্র না মেনে নিম্নমানের বই ছাপানোর কারণে এনসিটিবি প্রাথমিক স্তরে ৪৮ ও মাধ্যমিক স্তরের ২৯টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়। গত সপ্তাহে ওই চিঠি হাতে পাওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে দরপত্র অনুযায়ী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরায় বই প্রতিস্থাপন করার নির্দেশ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে এর বাইরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে; যারা শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের বই দিয়েও অদৃশ্য কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। অন্যদিকে অনিয়মে অভিযুক্ত কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বই প্রতিস্থাপন না করে ভুয়া ছাড়পত্র দেখিয়ে বিল উঠিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, গত বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ১১৬টি প্রেস বই ছাপার কাজ পায়। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে ইন্সপেকশন এজেন্সির প্রতিবেদনে ২৯টি প্রেস নিম্নমানের বই দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে সৃষ্টি প্রিন্টার্স, কচুয়া প্রেস, অনন্যা প্রিন্টার্স, অটো প্রিন্টিং প্রেস, অগ্রণী প্রিন্টার্স, সরকার প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন এবং কর্ণফুলী প্রিন্টার্সসহ আরও কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিম্নমানের বই ছাপানোর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এজেন্সির রিপোর্টে তাদের নাম বাদ পড়েছে। এর মধ্যে সরকার প্রেস শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের বই দিলেও তাদের কেবল দায়সারা জরিমানা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে নিম্নমানের ছাপানোর দায়ে ৪৮ প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এলে সেখানে উল্লেখিত কয়েকটি প্রেসের নাম নেই।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইন্সপেকশনের রিপোর্ট অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়েছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পুনরায় শিক্ষার্থীদের বই প্রতিস্থাপন করতে না পারলে তাদের আর্থিক জরিমানা করা হবে। মাঠপর্যায়ে জরিপ করে আমরা একটা প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। যেসব প্রেস নিম্নমানের বই ছাপানোর পরও অধরা রয়েছে, তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।’
এনসিটিবির সূত্রে জানা যায়, চলতি শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০ কোটির বেশি বই ছাপানো হয়েছে। সেসব বইয়ের মান যাচাই করতে পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন (পিএলআই) এজেন্ট হিসাবে ‘হাইটেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন বিডি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয় এনসিটিবি। এই এজেন্সির সারা দেশ থেকে বইয়ের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্টের পর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ১৮ জুন প্রতিবেদনটি জমা দেয় ওই এজেন্সি। এতে শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের বই দিয়েও প্রতিবেদন থেকে বাদ পড়েছে একাধিক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কাউকে বাদ আবার কাউকে যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া মাস্টার সিমেক্সসহ কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান এই পরিদর্শন এজেন্সির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে তাদের প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এমন অভিযোগের পর পুরো ঘটনা তদন্তে এনসিটিবি বিশেষজ্ঞ ড. মো. ইকবাল হায়দারকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের কমিটি করেছে এনসিটিবি। কমিটির আজ-কালের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ১০ কোটি বই ছাপানো হয়। সেসব বই যাচাই করতে ফনিক্স ইন্সপেকশন এজেন্ট (বিডি) নিয়োগ দেয় এনসিটিবি। তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসে নিম্নমানের বই দেওয়া ৪৮ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম। সেখানেও অদৃশ্য কারণে নিম্নমানের বই দেওয়া কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম বাদ পড়েছে। এ নিয়ে এনসিটিবির ভেতরে-বাইরে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। সম্প্রতি এনসিটিবির উদ্যোগে ৩২টি দল ৬৪ জেলা থেকে বই সংগ্রহ করেছে। সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের বই দেওয়া ৯২টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে। তবে পিএলআই এজেন্সির সঙ্গে এনসিটিবির প্রতিবেদনের মিল নেই। যদিও এনসিটিবির প্রতিবেদনটি খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
এনসিটিবিতে প্রাথমিক স্তরে দরপত্র অনুযায়ী নিম্নমান বা ত্রুটিপূর্ণ বই ছাপানোর দায়ে ৪৮ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্সি। সেগুলো হলো-ফরাজী প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, দশদিশা প্রিন্টার্স, এস. আর. প্রিন্টিং প্রেস লি., মহানগর অফসেট প্রিন্টিং প্রেস, অটো প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, এস. এস প্রিন্টার্স, নুরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস, মেসার্স মুত্তাহিদা প্রিন্টার্স, প্রমা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, স্বায়ন মনি প্রিন্টার্স, বারোতোপা প্রিন্টার্স লি., লেটার এন কালার লি., শেলী প্রিন্টার্স, মেসার্স মেরাজ প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, মেসার্স নাহার প্রিন্টার্স, ন্যাশনাল প্রিন্টার্স, মাস্টার সিমেক্স পেপার লি., আনমন নিউ অফসেট প্রেস, এপেক্স প্রিন্টিং অ্যান্ড কালার লি., আমিন আর্ট প্রেস, রিফাত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, মানামা প্রিন্টার্স, মোসা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স., বৃষ্টি প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, অনন্যা প্রিন্টার্স, বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লি., সরকার প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স., মৌসুমী অফসেট প্রেস, অনুপম প্রিন্টার্স লি., টাঙ্গাইল অফসেট প্রেস, সোমা প্রিন্টিং প্রেস, শিশির প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, বর্ণমালা প্রেস, অনিন্দ্য প্রিন্টিং প্রেস, সমতা প্রেস, রেদুয়ানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, অ্যারিস্ট্রক্রেস্ট সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লি., আনন্দ প্রিন্টার্স লি., দিগন্ত অফসেট প্রিন্টার্স, প্রিয়াংকা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, গ্লোবাল প্রিন্টিং ইকুইপমেন্ট, বর্ণালী অফসেট প্রিন্টার্স, মেসার্স করতোয়া প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, আলিফ প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, সরকার প্রেস, মেসার্স ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, সাগরিকা প্রিন্টার্স ও সরকার অফসেট প্রেস। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রেস এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছে। পুনরায় তদন্ত করার জন্য এনসিটিবিতে আবেদনও দিয়েছে তারা।
মাধ্যমিকের স্তরে ২৯টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান চলতি শিক্ষাবর্ষে মোট ১৫ লাখ ৬ হাজার ৯৪টি নিম্নমানের বই ছেপেছে। এগুলোর মধ্যে অ্যারিস্ট্রোক্রেট সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, পাঞ্জেরী প্রিন্টার্স, লেটার অ্যান্ড কালার, নাহার প্রিন্টার্স, আমাজন প্রেস, টাঙ্গাইল অফসেট প্রেস, বর্ণমালা, দিগন্ত অফসেট প্রিন্টার্স, রেদওয়ানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন, দ্য গুডলাক প্রিন্টার্স, মিলন প্রিন্টিং প্রেস, সুবর্ণা প্রিন্টার্স, নাইমা আর্ট প্রিন্টার্স, আনন্দ প্রিন্টার্স লি., অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন, শাফিন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন, আমিন আর্ট প্রেস, মাস্টার সিমেক্স পেপার লি., সরকার প্রেস, অনুপম প্রিন্টার্স লি., মেসার্স ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, দোয়েল প্রিন্টার্স, পিবিএস প্রিন্টার্স, সরকার অফসেট প্রেস, ন্যাশনাল প্রিন্টার্স, ঢাকা প্রিন্টার্স, ভাই ভাই প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন, জিতু অফসেট প্রেস ও মহানগর অফসেট প্রিন্টিং প্রেস।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফাতিহুল কাদীর যুগান্তরকে বলেন, ইন্সপেকশন এজেন্সির পাশাপাশি আমরা নিজেরাও মাঠ থেকে বই সংগ্রহ করেছি। আমাদের প্রতিবেদনের সঙ্গে পিএলআই এজেন্সির তথ্যের মিল নেই। ইতোমধ্যে পিএলআই এজেন্সি হাইটেক তাদের প্রতিবেদনের সংশোধনী দিতে চেয়েছে। আমরা এ বিষয়ে সম্মতি দেইনি। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ে সঠিক তথ্য তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। এতে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবার অনেকেই অধরা থেকে গেছেন।