Image description

ড. মোহাম্মদ নকিবুর রহমান
***********************************
আমি কখনো নিউ ইয়র্কে থাকিনি, কিন্তু এই শহরের রাস্তাগুলো আমার শরীরে মিশে গেছে।
আমার প্রথম আমেরিকা-দেখা JFK এয়ারপোর্টের সাদা আলোতে ভেজা করিডোরে। তারপর যতবার এসেছি, নিউ ইয়র্ক হয়ে উঠেছে একধরনের অভ্যন্তরীণ দিকচিহ্ন—উচ্চকণ্ঠ, অসাধারণ, কখনো-কখনো নির্মম। এখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষাই শ্বাস, আর পরিচয় প্রতিনিয়ত জেরা হয়।
আমি এসেছিলাম ৯/১১-র কিছু আগে। কয়েক মাসের মাথায় নিরাপত্তা নামের মোহটা ভেঙে পড়ল। একদিন FDR ড্রাইভে গাড়ি চালানোর সময়, পাশের গাড়ি থেকে একজন থুতু ছুঁড়ে দিল আর অশ্লীল ভঙ্গি দেখাল। কারণ? আমার বন্ধুর স্ত্রী হিজাব পরেছিলেন।
এটাই ছিল আমার নতুন আমেরিকার স্বাগতবার্তা: প্রকাশ্য বিদ্বেষ, নিত্যদিনের ঘৃণা, আর ইসলামবিদ্বেষ—দেশপ্রেমের নামে মোড়ানো। নিউ ইয়র্কের মতো ‘প্রগতিশীল’ শহরেও।
এই শহরে এখন যা ঘটেছে, সেটা একটা বিপ্লব ছাড়া কিছু না।
------------------------------------------------------------
জোহরান মামদানি ডেমোক্রেটিক পার্টির মেয়র প্রাইমারিতে জিতেছেন। কিন্তু এটা স্রেফ রাজনৈতিক অঘটন না। এটা ছিল একটা বিস্ফোরণ—তাদের মুখে যারা দিনের পর দিন আমাদের মতো মানুষদের বুঝিয়ে এসেছে: “তোমরা আসলে এখানে ঠিক মানিয়ে নাও।”
এই জয় একটা বার্তা—ক্ষমতা কারও জন্মগত অধিকার না। আর যে পরিচয় নিয়ে অন্যেরা তোমাকে ছোট করে দেখে, সেটা যদি তুমি নিজের করে নিতে পারো, তবে সেটা দুর্বলতা না, বরং শক্তি।
গত কয়েক মাস ধরে আমি দেখেছি কীভাবে ভয় ছড়িয়েছে। ভেতরের লোকজন, দলীয় কর্মী, বড় বড় ডোনাররা জানুয়ারিতে বলেছিল—“মুসলমান প্রার্থী? নিউ ইয়র্কে কখনো না!”
ফেব্রুয়ারিতে বলা হলো—“ফিলিস্তিনপন্থী কেউ এখানে জিততে পারবে না!”
মার্চে এসে বলা হলো—“সোশ্যাল মিডিয়াতে ফলোয়ার আছে তো কী, ভোটে তো আর রূপ নেবে না!”
অন্যদিকে অ্যান্ড্রু কুওমো—সাবেক গভর্নর, আরেক গভর্নরের ছেলে—যেন আগেই নির্বাচিত। বড় কর্পোরেট, লেবার ইউনিয়ন, মিডিয়া—সবাই তাকে হাত ধরে নিয়ে এল। প্রশ্ন না করেই ধরে নিল, “এই লোকই তো হবেন আমাদের পরের নেতা!”
বলেছিল মামদানি পাবে পাঁচ শতাংশ। ভাগ্য ভালো হলে দশ।
তারা ভুল ছিল।
এক আন্ডারডগের পাল্টা জবাব
--------------------------------
এই জয় নিউ ইয়র্কের সেই পুরনো ‘আমরা তো ব্যতিক্রমধর্মী, প্রগতিশীল’ গল্পে এক নতুন অধ্যায়। সেই গল্পে এতদিন ধরে বাদ পড়ে গেছে অসংখ্য মানুষ।
কিন্তু কখনো কখনো, সেই আন্ডারডগ-ই আসে আর খেলার নিয়মটাই বদলে দেয়।
এই পুরো প্রচারাভিযান দেখার সময় আমি বারবার বাংলাদেশকে ভেবেছি—আমার জন্মভূমি।
মজার বিষয় হলো, মিলগুলো চোখে পড়ার মতো।
সেখানে এখনো রাজনীতিতে রাজবংশদের দাপট।
সেখানেও ধর্ম ব্যবহৃত হয় অস্ত্রের মতো, পরিচয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
কিন্তু দুই জায়গাতেই, সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিদ আর বিশ্লেষকদের চেয়েও বেশি সাহসী, আর অনেক বেশি কল্পনাশীল।
মামদানি আমাদের সেই পুরনো গল্পটা ছিঁড়ে ফেলেছেন—“কে প্রার্থী হতে পারে, কারা গ্রহণযোগ্য।”
এই গল্পটা শুধু নিউ ইয়র্কে না, আরও অনেক জায়গায় টিকছে না।
প্রথমে শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে—নিউ ইয়র্ক আর ঢাকা একসাথে? আমেরিকা আর বাংলাদেশ?
দুটি ভিন্ন মহাদেশ, ভিন্ন ব্যবস্থা, ভিন্ন বাস্তবতা।
কিন্তু ভেতরে ঢুকলে মিলগুলো অস্বীকার করা যায় না।
নিউ ইয়র্কের ভোটাররা বৈচিত্র্যে ভরপুর—৩৬% বিদেশে জন্ম নেওয়া, ৮৫% নাগরিক। ইহুদি সম্প্রদায় জনসংখ্যার ১১ শতাংশ হলেও, প্রাইমারিতে প্রায় ২০ শতাংশের বেশি ভোট দেয়।
তারা সাধারণত মূলধারার প্রার্থীকে ভোট দেয়।
মুসলিমরা, এখন শহরের প্রায় ৯ শতাংশ, বেশিরভাগই বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আরব বিশ্ব আর পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আসা।
তাদের রাজনীতি প্রগতিশীল।
লাতিনো আর এশীয়রা মিলে যে জোট গড়ে উঠেছে, সেটা এক রকম “গ্লোবাল মেজরিটি।”
এখানে জিততে হলে, জোট গড়তে হয়—জাতি, ধর্ম, শ্রেণি, ইতিহাস সব মিলিয়ে।
তবু কুওমোর প্রত্যাবর্তন অনেকটা অভিষেকের মতোই। মিডিয়া প্রশ্ন করল না, শক্তিগুলো দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়াল।
এখন একটা মানসিক অনুশীলন করুন—কুওমোর জায়গায় বসান বিএনপি। নিউ ইয়র্কের জায়গায় রাখুন ঢাকা।
ছকটা একই।
বাংলাদেশের গল্পটাও চেনা
-----------------------------
বাংলাদেশে ব্যবসায়িক ও মিডিয়া গোষ্ঠীরা আগে থেকেই ধরে নিয়েছে—বিএনপি-ই হবে পরবর্তী সরকার।
যদিও তাদের ভিত দুর্বল, মাঠে প্রভাবও সেভাবে নেই।
তাদের সমর্থন দিচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপের মতো কর্পোরেট, কিছু ভারতঘেঁষা রাজনীতিক, আর প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের মতো মিডিয়া—যারা এই প্রেক্ষাপটে CNN, Bloomberg বা নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর জায়গা নিচ্ছে।
চিত্রনাট্য খুব চেনা: প্রার্থী বেছে নেন উপরওয়ালারা, গল্প লেখা হয় উপর থেকে, আর ভিন্নমত চেপে রাখা হয়।
মামদানির মতোই, কিছু দল বা মানুষকে বলা হয়—“তোমরা এই গল্পের অংশ না।”
বাংলাদেশে এমন চরিত্র হতে পারে জামায়াতে ইসলামী।
গ্রাসরুটে শক্ত উপস্থিতি, বছরের পর বছর সামাজিক সংগঠনের কাজ—তবু দলটিকে মূলধারার রাজনীতি থেকে বাদ রাখা হয়েছে।
তাদের বলা হয়—“তোমরা বৈধ না, গ্রহণযোগ্য না।”
মামদানির বিরুদ্ধে তোলা হয়েছিল ৯/১১। জামায়াতের বিরুদ্ধে আনা হয় ১৯৭১।
মামদানিকে বলা হয়েছিল—ইসরায়েলকে সমালোচনা করা যাবে না।
জামায়াতকে বলা হয়—ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না।
যেই যুক্তি: “যদি বিরোধিতা করো, তাহলে তুমি বাদ।”
কিন্তু মামদানি দেখিয়ে দিয়েছেন—অন্যরকম রাজনীতি সম্ভব।
জনগণের সঙ্গে থাকা, তথ্যনির্ভর কাজ, আর আদর্শ নিয়ে আপস না করেই।
সে ভয় পায়নি। আর এখানেই মূল শিক্ষা:
জয় কারো দয়া নয়। জয় আসে কঠোর সংগঠন, স্পষ্ট বার্তা, আর নৈতিক সাহস থেকে।
এই শিক্ষা যেমন কুইন্সে সত্যি, তেমনি ঢাকাতেও।
এই জয় একটা বার্তা—সবাইকে উদ্দেশ্য করে
----------------------------------------------
আজ মামদানির জয় শুধু তার নিজের না।
এটা সেইসব মানুষদের, যাদের এতদিন বাদ দিয়ে রাখা হয়েছে, তাচ্ছিল্য করা হয়েছে, বলেই দেওয়া হয়েছে: “তোমরা কখনো জিততে পারো না।”
এটা সেই প্রতিষ্ঠিত গল্পের বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ, যা বলে—“যার পকেটে টাকা আছে, মিডিয়ায় নাম আছে, সে-ই জিতবে।”
না, গণতন্ত্রে এমন কিছু নেই।
গণতন্ত্রে কেউ আগে থেকেই জেতা থাকে না। সেখানে প্রতিটি ভোট, প্রতিটি কণ্ঠ—গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা কুরআনের সেই আয়াতটা মনে রাখতে পারি—সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৪৯:
"কত ছোট একটি দল, আল্লাহর ইচ্ছায় বড় একটি বাহিনীকে হারিয়েছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।"
এই বার্তা নিউ ইয়র্কের জন্য, বাংলাদেশের জন্য, আর সবার জন্য—যাদের কখনো বলা হয়েছে: “তোমরা ভিন্ন, অচেনা, বা উপযুক্ত নও নেতৃত্বের জন্য।”
তোমাদের সময় কল্পনা নয়। এটা হুমকি। আর সেটা আসছে।
শুধু এটুকু নিশ্চিত করো—তোমার ভোট না পড়া পর্যন্ত কাউকে বিজয়ীর মুকুট যেন পরানো না হয়।

ড. মোহাম্মদ নকিবুর রহমান
অধ্যাপক, ফিন্যান্স বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলাইনা