
আলোচিত ‘ছিটমহল’ দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। চারদিকে ভারতীয় সীমান্তঘেরা হওয়ায় একসময় এলাকাটি দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল। সে সময় সেখানকার অধিবাসীদের নিজ ভূমে আসতে হতো প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে; অনেক সময় নানা নিয়মের মধ্যে কিংবা কৈফিয়তের মুখোমুখি হয়ে। ছিল না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা সুবিধা। ফলে অনেকে চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে মারা গেছেন। খুব কম মানুষেরই ভাগ্যে জুটেছে দেশের মূল ভূখণ্ডে এসে লেখাপড়া করার সুযোগ। বলতে গেলে অবরুদ্ধ ছিলেন সেখানকার অধিবাসীরা।
তবে বিএনপির শাসনামলে ১৯৯২ সালের ২৬ জুন কিছুটা স্বস্তি ফেরে সেখানকার অধিবাসীদের মাঝে। দুই দেশের সংযোগস্থলের ‘তিনবিঘা’ জমি বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেয় ভারত। এরপর উভয় পাশে দুটি গেট নির্মাণ করে প্রতিবেশী দেশ; যা তিনবিঘা করিডর নামে পরিচিত। এর ফলে প্রথমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১ ঘণ্টা পরপর করিডর খুলে রাখত বিএসএফ। আর এ সময়ের মধ্যে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসী লালমনিরহাটের পাটগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে আবার বাড়ি ফিরতেন।
বাংলাদেশের দাবির প্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টা করিডর খুলে রাখা শুরু হয়। সে সময় ওই ছিটমহলের একজন বাসিন্দা মূল ভূখণ্ডে এসে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে ফিরতে না পারলে ওই দিন আর তার বাড়ি ফেরা হতো না। কারণ নির্দিষ্ট সময়ে করিডর বন্ধ করে দিত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তবে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির পর থেকে করিডরটি ২৪ ঘণ্টার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ফলে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন সেখানকার অধিবাসীরা। প্রায় ২০ হাজার মানুষের সেই ছিটমহল এখন দহগ্রাম নামের একটি ইউনিয়ন। ইতোমধ্যে সেখানে গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হয়েছে পাকা রাস্তা, পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। আছে হাসপাতাল, পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র। সবকিছু মিলে কিছুটা ভালোই কাটছে সেখানকার মানুষদের জীবন। তবে এখনো রয়েছে নানা সমস্যা। এর বাইরে ৫ আগস্টের পর যুক্ত হয়েছে তিনবিঘা করিডর দিয়ে ভারী যানবাহন চলতে না দেওয়ার নতুন এক সমস্যা। কোনো কারণ ছাড়াই বিএসএফ করিডর দিয়ে বাস-ট্রাকের মতো যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।
এ কারণে একদিকে সমস্যায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা; অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না চাষিরা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দহগ্রামের মানুষের জন্য নির্মিত ২০ শয্যার হাসপাতালটি এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১১ সালে চালুর পরপরই বন্ধ হয়ে গেছে আন্তঃবিভাগ। বহির্বিভাগ চালু থাকলেও চলছে খুঁড়িয়ে। হাসপাতালে দেখা মেলে না চিকিৎসকের। মাঝে-মধ্যে ‘ওয়ার্ডবয়’ এসে বহির্বিভাগের রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেন। এর বাইরে তিস্তা নদীর ভাঙনেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। একমাত্র উচ্চবিদ্যালয়টি ধুঁকছে শিক্ষক সংকটে। দহগ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ আলী বলেন, ‘প্রথমে ১০ বেডের হাসপাতাল ছিল। পরে ২০ বেডে উন্নীত করা হলেও হাসপাতালটি কোনো কাজেই আসছে না। ডাক্তার না এসেই বেতন নেন। কিন্তু আমরা চিকিৎসা পাই না। তাই বাধ্য হয়ে পাটগ্রাম বা অন্য কোনো হাসপাতালে যেতে হয়।’ ইউসুফ আলীর মতো আরও অনেকের একই অভিযোগ। আঙ্গরপোতার ব্যবসায়ী শাহিনুল ইসলাম বলেন, ‘করিডর দিয়ে ৬ চাকার পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় এখানকার ব্যবসায়ী-কৃষক উভয়েই সমস্যায় পড়েছেন। ভুট্টা, ধান, তামাকের মতো ফসল এখন ট্রাক্টর বা ভ্যানগাড়িতে করিডরের বাইরে নিতে হয়। আবার বিভিন্ন জিনিস দহগ্রামে আনতেও ছোট গাড়ি ব্যবহার করতে হয়, বড় ট্রাক চলাচল করতে না দেওয়ার কারণে।’
আব্দুল করিম নামের একজন কৃষক বলেন, ‘বড় ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় পাটগ্রামের তুলনায় আমরা প্রতি মন ফসলে কমপক্ষে ১০০ টাকা কম দাম পাই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা।’
তবে দহগ্রাম হাসপাতালে ডাক্তার থাকেন না এমন অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয় বলে দাবি করেছেন পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দেবব্রত রায়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘একজন চিকিৎসক ওখানে (দহগ্রাম হাসপাতালে) চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। তবে জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালটির আন্তঃবিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ ওখানে চারজন চিকিৎসকের পদ থাকলেও আছেন মাত্র একজন। এছাড়া নার্স পদে চারজন থাকার কথা থাকলেও এখন তা শূন্য।’ প্রতিবছর ২৬ জুন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা মুক্ত দিবস কর্মসূচি পালন করা হয়। এবারও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে দিবসটি উপলক্ষ্যে আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে র্যালি ও আলোচনা সভা হবে।
জানতে চাইলে সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক রেজানুর রহমান রেজা বলেন, ‘১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী আমরা দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। বিনিময়ে ভারত আমাদের তিনবিঘা করিডর নামে পরিচিত জায়গাটি ছেড়ে দেবে। কিন্তু সেটি না করে ভারত আমাদেরকে মাত্র ১০ ফিট প্রশস্ত এবং ১৭৮ ফিট লম্বা একটি রাস্তা দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে সেটি দিয়েও বাস ও বড় ট্রাক চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। আমরা ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী ৮৫ ফিট প্রশস্ত এবং ১৭৮ ফিট লম্বা জায়গাটি (তিনবিঘা করিডর) ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানাই।’