
ব্যাংক খাতে আস্থা ফেরাতে দুর্বল পাঁচটি ইসলামি ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এক্সিম ব্যাংক এ প্রক্রিয়ায় তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে নানা জাটিলতা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগে একদিকে তৈরি হয়েছে একটি শক্তিশালী ইসলামি ব্যাংক গঠনের সম্ভাবনা, অন্যদিকে গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। অনেক গ্রাহক আমানতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, আবার দুর্বল ব্যাংকগুলোর কর্মীরা আশঙ্কায় রয়েছেন চাকরি হারানোর। কয়েকটি ব্যাংক ইতোমধ্যে আমানত হারাতে শুরু করেছে। মার্জারের বিরোধিতায় সরব হয়েছে এক্সিম ব্যাংক। তাদের দাবি, তারা একটি স্বনির্ভর, শক্তিশালী ব্যাংক এবং অন্য কোনো দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ হওয়া তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) বলছে ভিন্নকথা। এক্সিম ব্যাংকের ৫২ হাজার ৭৬ কোটি টাকার বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ২৫ হাজার ১০১ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৪৮.২০ শতাংশ। এছাড়া প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচটি ব্যাংকের মোট আমানত ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণ ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা হলেও এর মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকাই খেলাপি ঋণ, যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। সমন্বিতভাবে এ ব্যাংকগুলোর পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। কিন্তু মূলধন ঘাটতির অঙ্ক বিশাল। এত বিপুল খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতির মধ্যেও গ্রাহক সংখ্যা ৯২ লাখ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৬ হাজার। এই বিপুল জনবল ও গ্রাহকগোষ্ঠী মার্জার-পরবর্তী সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে আছে।
আইএমএফের চাপ ও আন্তর্জাতিক নিয়ম : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ অতিক্রম করলে সেটিকে মৃত হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যাকে হয় দ্রুত বিলুপ্ত করতে হবে, নয়তো পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। পাঁচটি ব্যাংকই এই সীমা অতিক্রম করেছে। তাই আইএমএফের চাপেই হোক বা আর্থিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই হোক-বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ সিদ্ধান্তকে অনেকেই সময়োপযোগী মনে করছেন।
গভর্নরের নিশ্চয়তা : সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই মার্জার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং কয়েক মাসের মধ্যেই এটি বাস্তবায়ন হবে। তিনি আরও বলেন, এই মার্জারে কারও চাকরি যাবে না। অতিরিক্ত শাখাগুলো শুধু শহর থেকে গ্রামে স্থানান্তর করা হতে পারে।
বিশ্লেষকের অভিমত : নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংক খাতের একজন বিশ্লেষক যুগান্তরকে বলেন, এ পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে একটি বড় ব্যাংক তৈরি হবে। শাখা, কর্মকর্তা, গ্রাহক ও সম্পদের পরিমাণ একত্রে বিশাল হবে। দুর্বল অ্যাসেটগুলো এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবস্থাপনায় আনা হবে। প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি পূরণেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সম্ভাব্য সুফল : একীভূত ব্যাংকে ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫০০টি এজেন্ট আউটলেট এবং ১,০০০টির বেশি এটিএম বুথ নিয়ে গড়ে উঠবে দেশের বৃহত্তম ইসলামী ব্যাংক। এ ব্যাংক ব্যাংকিং সেবার আওতা বাড়িয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখতে পারবে। মার্জারের ফলে খরচ কমবে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে এবং দক্ষ মানবসম্পদের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়বে।
সার্বিকভাবে ব্যাংক মার্জার দেশের ব্যাংকিং খাতে কার্যকারিতা, স্থিতিশীলতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে বলে মত দিয়েছেন একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে এক্সিম ব্যাংকের আমানত ৪২,৯৯৩ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ৫১,৬৪২ কোটি, খেলাপি ঋণ ২৫,১০১ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ১,৪৪৮ কোটি, শাখা ১৫৫টি এবং লোকসান ৪০৯ কোটি টাকা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আমানত ৩০,৯৭৭ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ৩৫,২২০ কোটি, খেলাপি ঋণ ২৩,৫৭৫ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ১,১৪০ কোটি, শাখা ১৮১টি এবং লোকসান ৫৩ কোটি টাকা।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের আমানত ১২,৩১৩ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ১৪,৪২৭ কোটি, খেলাপি ঋণ ১৩,৫৬৯ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ৯৮৭ কোটি, শাখা ১০৪টি এবং লোকসান ২১৪ কোটি টাকা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের আমানত ১৭,৯৪২ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ২৮,২৭৯ কোটি, খেলাপি ঋণ ২৬,৪৯১ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ১,০৩৬ কোটি, শাখা ১১৪টি এবং লোকসান ৮০ কোটি টাকা।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আমানত ৪৩,১৪৩ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ৬০,৯১৫ কোটি, খেলাপি ঋণ ৫৮,১৮২ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ১,২০৮ কোটি, শাখা ২০৬টি এবং লোকসান ৪০৫ কোটি টাকা।