Image description

বাঙালির আদি পরিচয় ‘মাছে-ভাত’ বাঙালি। এটি আমাদের খাদ্যসংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। কিন্তু বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে সেই মাছ-ভাতই এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার উৎস। তিন বছরের বেশি সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধকলে থাকা মানুষকে খাবারের উচ্চমূল্যের চাপ সামলাতে হয়েছে। সরকারি তথ্য বলছে, খাদ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পেছনে প্রায় ৭০ শতাংশ প্রভাব রাখছে চাল ও মাছের দাম। অর্থাৎ এই দুই আবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের দাম এখনো নাগালের বাইরে।

মে ২০২৫ পর্যন্ত সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে খাদ্যপণ্যের দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। চাল ও মাছই ছিল এর মূল চালিকাশক্তি। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) জুন ২০২৫ অর্থনৈতিক আপডেট অনুসারে, মে মাসে চাল একাই ৪০ শতাংশ এবং মাছ ২৮ শতাংশ প্রভাব রেখেছে সামগ্রিক খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে মাঝারি চাল এককভাবে ২০ দশমিক ৪৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী, যা আগের মাসের তুলনায়ও বেশি। সাধারণ মানুষের পাতে তাই ভাতের পরিমাণ যেমন কমেছে, তেমনি চুলায় মাছ উঠানোও হয়েছে ‘ঐচ্ছিক’ নয়—‘ঐতিহাসিক’ সিদ্ধান্ত। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার তালিকায় আরো রয়েছে মাঝারি ও মোটা চাল, ইলিশ, পাঙাশ, বেগুন, সয়াবিন তেল, আম, কুমড়া ও লাউ। এসব খাতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে। কমেছে আলু ও মুরগির দাম।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাজার অস্থিরতার পেছনে দায়ী মূলত সিন্ডিকেট। সরকারের অনেক চেষ্টার পরও বাজার ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও চালের বাজারে অস্থিরতা রয়েই গেছে।

বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে জানিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী আমার দেশকে বলেন, ভাত ও মাছÑ এ দুটি পণ্যই দরিদ্র মানুষের পুষ্টির প্রধান উৎস। মাছ গরিবের প্রোটিনের প্রধান উৎস, কারণ তারা মাংস কিনে খেতে পারে না। মুরগি, গরু ও খাসির মাংসের দাম তাদের আওতার বাইরে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিবিএস আমাদের যেসব তথ্য দিচ্ছে তাতে দেখা যায়, মাছের উৎপাদন অনেক বেড়েছে, কালচার ফিশারিজ বেড়েছে। বিগত দশকে মাছের উৎপাদন অনেকটা বেড়েছে।

ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, একই তথ্য আসে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে। প্রতি বছরই শুনি বাম্পার ফলন হচ্ছে, উৎপাদনের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মাছ ও চালের দাম অনেকটাই মুখোমুখি। ধানের সাম্প্রতিক উচ্চ ফলনের পরও চালের দাম কমেনি। সরকার উল্টো বিদেশ থেকে আমদানি করেছে। তারপরও চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মাছের ক্ষেত্রেও কমদামি মাছগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যদি বিবিএসের তথ্য সঠিক হয়Ñ ‘উৎপাদন অনেক বেড়েছে’, কিন্তু এত উৎপাদনের পরও দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের আওতার বাইরে পণ্যের দাম।

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ‘আমাদের বিপণন ব্যবস্থায় অনেক বড় ত্রুটি আছে। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে নেই। চালের যে পরিমাণ উৎপাদন, এর বিপরীতে আমাদের উদ্বৃত্ত থাকার কথা। আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য ধরলে যে পরিমাণ চাল আমরা দৈনিক ভোগ করি, তার বিপরীতে আমাদের উদ্বৃত্ত থেকে রপ্তানি করার কথা। আমরা উল্টো চাল আমদানি করছি। অর্থাৎ বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ত্রুটি আছে।’

খাদ্যশস্যে উচ্চ উৎপাদন সত্ত্বেও বাজারে তার সুফল এখনো পৌঁছায়নি। বোরো ধানের ফলন ভালো হলেও, ধান সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ এবং পাইকারি পর্যায়ে কিছু অসামঞ্জস্যতার কারণে চালের দাম অস্থিতিশীল।

একই সময়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মে মাসের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে গম আমদানি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মে মাস পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে দেশে ৫৫ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। বিশ্ববাজারে কম দাম, সরবরাহ শৃঙ্খলের উন্নতি এবং স্থানীয় বাজারে চাহিদা বাড়ার কারণে এই প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। পর্যাপ্ত মজুত বজায় রাখতে এবং চালের দাম বাড়ায় লাগাম টানতে চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ২০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে সরকার।

২০২৫ সালের মে মাসে সরকারি গুদামে চালের মজুত ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টন। আসন্ন অভ্যন্তরীণ বোরো ধান সংগ্রহের পর বর্তমান সরকারি মজুত সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে আশা করছে সরকার। খাদ্য সরবরাহ ঘাটতির ঝুঁকি কমাতে এবং দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার চাল আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি কেনাকাটা শিথিল করেছে।

খাদ্যঝুড়ির খরচ কমেছে

২০২৫ সালের মে মাসে একটি খাদ্যঝুড়ির জাতীয় মাসিক খরচ ৫৮ টাকা কমে ব্যক্তিপ্রতি মাসে ২ হাজার ৮৪২ টাকায় নেমেছে। চাল, ডাল, আলু, মুরগি, মাছ, চিনি এবং তাজা শাকসবজির মতো কিছু মৌলিক খাদ্যদ্রব্যের দামের নিম্নমুখী প্রবণতার কারণে এই মাঝারি পতন ঘটেছে বলে উঠে এসেছে ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে বেশকিছু কাঠামোগত পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। যেমনÑ কৃষি আয়ে আয়কর ছাড়। ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কৃষি আয়ের ওপর করমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এছাড়া ১১০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার ও ৪৪২টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক হ্রাস এবং ট্যারিফ ভ্যালু বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে আমদানি করা পণ্যের দাম কমে। কম্বাইন হারভেস্টর তৈরির যন্ত্রাংশেও শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে, যাতে চাষাবাদ আরো আধুনিক হয়।

রমজান ও ঈদের প্রভাবেও এপ্রিল মাসে রপ্তানি হঠাৎ কমে ৩০২ কোটি ডলারে নেমে আসে। তা সত্ত্বেও মে মাসে তা বেড়ে ৪৭৪ কোটি ডলারে পৌঁছায়, যা পুরো বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হারের চাপে টাকার মান কমেছে— ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রতি ডলার ছিল ১০৮ টাকা ৯৬ পয়সা, যা মে এসে দাঁড়ায় ১২২ টাকায়। আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্যের দাম এতে আরো বেড়ে যায়।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার বাজেটে যত পরিকল্পনাই করুক, তার প্রভাব ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছাতে সময় লাগে। আবার বাজারে সরবরাহ চক্রে সামান্য বিঘ্ন ঘটলেই মূল্যস্ফীতির আগুন জ্বলে ওঠে। বাঙালির চিরচেনা খাবার মাছে-ভাতে যে চাপ পড়েছে, তার থেকে মুক্তি পেতে দরকার সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ।