Image description

জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট ঢাকার আশুলিয়ায় ঘটে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ছয়জনের নিথর দেহ গাড়িতে উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলে পুলিশ। এদের মধ্যে একজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। লাশ পোড়ানোর সেই ভিডিও দেখে আঁতকে উঠেছিল গোটা দেশ। দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এরকম লোমহর্ষক তথ্য উঠে এসেছে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদনে। মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম ও ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফীসহ ১৬ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। এটিই তৃতীয় কোনো মামলা, যার তদন্ত সম্পন্ন হলো। গত ১৯ জুন চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে প্রতিবেদনটি জমা দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

যাচাই-বাছাই শেষে এটি ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ হিসেবে দাখিল করবে প্রসিকিউশন। আগামী ২ জুলাই দিন রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানি ১ জুলাই নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুম, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় আরও দুই মাস বাড়ানো হয়েছে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার পৃথক এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

আশুলিয়া মামলার প্রতিবেদন দাখিল : ট্রাইব্যুনালে মঙ্গলবার প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন সাইমুম রেজা তালুকদার, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হোসাইন তামিম প্রমুখ। আদালতে আশুলিয়া মামলার প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি জানান প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার। মামলার ১১ জন আসামির নাম উল্লেখ করেন সাইমুম রেজা। এরা হলেন সাবেক সংসদ-সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, আশুলিয়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ (রনি), ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) উত্তরের সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক আবদুল মালেক, সাবেক উপপরিদর্শক আরাফাত উদ্দীন, সাবেক উপপরিদর্শক শেখ আবজালুল হক, সাবেক উপপরিদর্শক বিশ্বজিৎ সাহা, সাবেক উপপরিদর্শক কামরুল হাসান ও সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার। এই ১১ জনের মধ্যে আটজন কারাগারে আছেন। মঙ্গলবার ছয়জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন আব্দুল্লাহিল কাফী, শাহিদুল ইসলাম, এএফএম সায়েদ, আরাফাত হোসেন, মালেক ও মুকুল।

পরে মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গত ১৯ জুন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের জন্য আমরা এক সপ্তাহ সময় চেয়েছি। আগামী ২ জুলাই ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হবে। এ ঘটনায় ১৬ জনের সম্পৃক্ততা মিলেছে, এর মধ্যে সাতজন গ্রেফতার রয়েছেন।

জীবিত একজনকে পুড়িয়ে হত্যা করে পুলিশ : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর বাইরে একজন গুলিতে গুরুতর আহত ছিল। সবাইকে প্রথমে একটি ভ্যানে এবং পরে পুলিশের একটি গাড়িতে তোলা হয়। পরে এই ছয়জনকে (একজন জীবিত) আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে সাজ্জাদ হোসেন (সজল), আস সাবুর, তানজীল মাহমুদ সুজয়, বায়েজিদ বুসতামি, আবুল হোসেন ও অজ্ঞাত একজন মারা যান। সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম ও তার ক্যাডার বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে আশুলিয়ায় নিহত হন অন্তত ৩১ জন। পরদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ১৫ জন মারা যান। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল দেড় হাজারের বেশি মানুষ। যাদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। সাভার ও আশুলিয়ায় ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যান অন্তত ৭৫ জন। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে লাশ পোড়ানোর একটি ভিডিও। মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও লোমহর্ষক ওই ঘটনায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ছিল ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের।

ভিডিওতে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকাদের মধ্যে থেকে একটি লাশ তুলে গাড়িতে নিক্ষেপ করতে দেখা যায় পুলিশকে। সর্বশেষ লাশটি তুলে একটি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। শেষে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি দেখা মেলে। ভিডিওর ১ মিনিট ৬ সেকেন্ডে একটি পোস্টার দেখা যায়, যা স্থানীয় ধামসোনা ইউনিয়ন সভাপতি প্রার্থী ও ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেনের। সেই পোস্টারটি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ভিডিওটির ঘটনাস্থল আশুলিয়া থানার আশপাশে। পুলিশ লাশগুলো থানার সামনে নিয়ে যায়। সেখানে একটি পুলিশভ্যানে লাশগুলো রেখে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গত বছর ১১ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে দুটি অভিযোগ করা হয়।

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি ১ জুলাই : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ১ জুলাই নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার অন্য দুই আসামি হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তাদের মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হোসাইন তামিম। তার আগে ১৬ জুন পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে এক সপ্তাহের মধ্যে হাজির হতে দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

গুমের মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় দুই মাস বাড়ল : আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুম, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় আরও দুই মাস বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২৪ আগস্ট সময় নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার আসামিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত চারজনের নাম প্রকাশ করেছে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। তারা হলেন শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ ও টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান।