শেয়ারবাজারে অনিয়ম থামছেই না। এবার তা দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পৃক্ত হয়েছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ১২ মিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার কিনতে যাচ্ছে লেনদেন নিষ্পত্তিতে গঠিত নতুন কোম্পানি সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল)। প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা ১৪৪ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান টাটা কনসালট্যান্সির সঙ্গে চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে। চুক্তি সম্পন্ন হলে ১৬ মাস পর সফটওয়্যার মিলবে।এদিকে বিষয়টি নিয়ে জোরালো আপত্তি জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় দুই অংশীদার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। প্রতিষ্ঠান দুটি বলছে, বর্তমানে শেয়ারবাজারে লেনদেন ৩শ’ কোটি টাকার আশপাশে। এই সামান্য লেনদেনের জন্য এত দামি সফটওয়্যার এই মুহূর্তে দরকার নেই। সিসিবিএলে এই দুই প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত শেয়ার মোট শেয়ারের ৬৫ শতাংশ। তবে সিদ্ধান্তের পক্ষে এখনো অনড় সিসিবিএল কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটি গঠনের পর ৬ বছরেও কোনো কাজ শুরু করতে পারেনি। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে সিসিবিএলের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রসঙ্গত শেয়ারবাজারের লেনদেন নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া ঝুঁকিমুক্ত ও দ্রুত সম্পন্ন করতে ২০১৭ সালে আইন করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত লেনদেন নিষ্পত্তি করা। এজন্য এই আইনের আওতায় ২০১৯ সালে নতুন কোম্পানি সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিসিবিএল) গঠিত হয়। ৩শ’ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ প্রতিষ্ঠানটির ৪৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক ঢাকা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। ২০ শতাংশ শেয়ার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই)। ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএলের শেয়ার ১৫ শতাংশ। এছাড়া ১২টি ব্যাংকের ১ দশমিক ২৫ শতাংশ হিসাবে মোট ১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এগুলো হলো-অগ্রণী ব্যাংক, মার্কেন্টাইল, মধুমতি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬ বছরেও প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। অযথা অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছে।
মৌলিক অবকাঠামো উন্নয়নে সম্প্রতি ১২ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে ভারতীয় টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেসের কাছ থেকে সফটওয়্যার কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মূল সফটওয়্যারের দাম প্রায় ৭০ লাখ ডলার। আর প্রতিবছর ৫ লাখ ডলার করে ১০ বছর রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় ৫০ লাখ ডলার। এরপর সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বা সিসিপি প্রযুক্তি স্থাপনে ভারতের টাটা কনসালট্যান্সির সঙ্গে চুক্তির উদ্যোগ নেয়। গত বছরের ২৭ মার্চ সিসিবিএলের পরিচালনা পর্ষদের সভায় চুক্তির বিষয়টি অনুমোদিত হয়। এরপর আপত্তি জানায় ডিএসই ও সিএসই। তবে এখনো ক্রয় চুক্তি হয়নি। আগামীকাল মঙ্গলবার চুক্তির কথা রয়েছে। এদিকে ক্রয় চুক্তির আগ মুহূর্তে সিসিবিএলের প্রধান শেয়ারহোল্ডার ডিএসইর পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিলম্বের পাশাপাশি নানা অস্বচ্ছতার অভিযোগ তোলা হয়েছে। চিঠিতে ক্রয় স্থগিতের অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে ক্রয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ অস্বীকার করছে সিসিবিএল।
সূত্র জানায়, সফটওয়্যার ক্রয়ে গত বছর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে বিদেশি ৪টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্যে প্রাথমিক বাছাইয়ে দুবাইভিত্তিক ইনফেলিক্স মিডেল-ইস্ট এবং লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানাধীন শ্রীলংকাভিত্তিক কোম্পানি এলএসইজি বাদ পড়ে। দ্বিতীয় ধাপে বাদ পড়ে নিউইয়র্কভিত্তিক নাসডাক স্টক এক্সচেঞ্জের সহযোগী। ফলে টাটার দরপ্রস্তাব গ্রহণ করে সিসিবিএল।এদিকে কার্যক্রম না থাকলে গত ৫ বছরে বিশাল ব্যয় করেছে সিসিবিএল। আরনেস্ট ইয়ং নামে একটি প্রতিষ্ঠান দুই বছরে কনসালট্যান্সি ফি দিয়েছে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ সময়ে শুধু বোর্ড মিটিং ফি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা। এছাড়াও প্রতিষ্ঠার পর ডেটা সেন্টারের জন্য যন্ত্রপাতি কেনা হলেও স্থাপন হয়নি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির জনবল ৭ জন। কিন্তু টানা ৬ বছর ১৭ হাজার বর্গফুটের অফিস নেওয়া হয়েছে। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
জানতে চাইলে ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই। সিসিবিএলের কার্যক্রমে আমরা বাধা দিচ্ছি না। আমরা তাদের সহায়তা করতে চাই। তিনি বলেন, কোনো প্রকল্প শুরু করতে হলে তার ফাইন্যান্সিয়াল ফিজিবিলিটি (আর্থিক সম্ভাব্যতা) যাচাই করতে হয়। সিসিবিএলের সফটওয়্যার কেনার ক্ষেত্রে এটি করা হয়েছে কি না তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। এছাড়াও টেন্ডারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয়। এটি না করা হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যেমন আমাদের এবং শ্রীলংকার লেনদেনের আকার প্রায় কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে তারাও বিশাল প্রকল্প নিয়ে সেখান থেকে পিছিয়ে আসছে। বর্তমানে তারা আগের সফটওয়্যার আপডেট করে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের সলিউশন (সফটওয়্যার) ব্যবহার করছে। এটির খরচ মাত্র ৫ লাখ ডলার। তিনি বলেন, আমি বলছি না, আমাদেরকেও শ্রীলংকাকে হুবহু অনুসরণ করতে হবে। তবে বাস্তবতার আলোকে আমাদের জন্য সহায়ক সেটিই ভাবতে হবে। এটা ঠিক, সিসিবিএলে ডিএসইর মনোনীত পরিচালক ছিলেন। তবে তাদের এ বিষয়ে জানাবোঝা ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি আরও বলেন, ব্যবস্থাপনায় সমস্যা আছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৭ জন লোক। এই সাতজন লোকের জন্য ১৭ হাজার স্কয়ারফিটের অফিস। এসব এখনই দরকার ছিল কি না সেটি ভাববার বিষয়।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিসিবিএলের সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে জানায়, ডিএসই এই প্রকল্প বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কারণ তারা সিসিবিএলের ডাটা সেন্টার ডিএসইতে নিতে চেয়েছিল। সিসিবিএল সেখানে রাজি হয়নি। এছাড়াও ডিএসই থেকে দুইজন পরিচালক সিসিবিএলের বোর্ডে ছিল। তারা কখনো বোর্ড মিটিংয়ে আপত্তি জানায়নি।ওই সূত্র জানায়, সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণে অর্থের পরিমাণ বেশি নয়। কারণ ডিএসই বর্তমানে যে সার্ভেইল্যান্স সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, তার ব্যয় অনেক বেশি। সূত্রের দাবি, ছয় বছর বিলম্ব করা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেখানে এককভাবে শুধু সিসিবিএল দায়ী নয়। কারণ, ২০১৯ সালে কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হলেও আইন অনুযায়ী স্বতন্ত্র পরিচালক মনোনয়ন দিতেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ৫৩৫ দিন সময় নিয়েছে। এরপরও ৪২০ দিন বিলম্ব হয়েছে, যার ৩০২ দিন ছিল ডিএসই মনোনীত শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের কারণে। এছাড়া কেনাকাটার অনিয়ম নিয়ে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সত্য নয়। কেননা, এখানে সব ধরনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
এদিকে সফটওয়্যার ক্রয় প্রস্তাবসহ সিসিবিএলের সামগ্রিক কার্যক্রম নিয়ে লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছে ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)। এতে বলা হয়, গত ২০ বছর ধরে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের সফটওয়্যার দিয়ে লেনদেন চলছে। বর্তমানেও সেখানে কোনো সমস্যা নেই। এ অবস্থায় ১৪৪ কোটি টাকায় শুধু সফটওয়্যার ক্রয় অযৌক্তিক এবং সন্দেহজনক। তাদের অভিযোগ, এই সফওয়্যারের ক্রয়মূল্য বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। তা ছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য সিসিবিএল গঠন হলেও ডিএসইর সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। এছাড়া এই সফটওয়্যার যৌক্তিক নয়। কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক দুই চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন এবং শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম জোর করে এ প্রতিষ্ঠান চাপিয়ে দিয়েছেন।
জানতে চাইলে ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ব্রোকাররা বাজারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। কিন্তু সিসিবিএলে কী হচ্ছে, এর অপারেশনাল কার্যক্রম, বাণিজ্যিক দিক, এর সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা এবং অন্যান্য দিকসহ কোনো কিছুই আমরা জানি না। আমাদেরকে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ গত ১৫ বছর দেশ যেভাবে চলছে, সিসিবিএলও বর্তমানে সেভাবে চলছে। তিনি বলেন, একটি সফটওয়্যার কেনার কথা বলা হচ্ছে। এর টেন্ডার প্রক্রিয়া তাদের বোর্ড দেখবে। তবে এই সফটওয়্যারের দাম কত হওয়া উচিত, আমাদের দেশ থেকে কেনা যেত কি না, এগুলো অবশ্যই আমাদের জানার অধিকার আছে। কারণ শ্রীলংকাতে কম দামে অনেক ভালো সফটওয়্যার পাওয়া যায়। সেখানে এত দাম দিয়ে সফটওয়্যার কিনলে সেটি বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে কি না সেটি দেখার বিষয়।