অভূতপূর্ব রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। তিন দিনের মাথায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হলেও সরকার এখনো এখনো ধাতস্থ হয়নি ধাতস্ত হয়নি। বিভিন্ন খাতে সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্য ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এই সরকার। প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, সংস্কার ও বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার কোনো ঘাটতি নেই। গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪) ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় বাংলায় সাক্ষাৎকারটি নেন পত্রিকাটির সম্পাদক নূরুল কবীর। তাঁর সম্মতিক্রমে সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
নূরুল কবীর: আপনার চার মাস হলো প্রায়। এই চার মাস আর আগের চার মাসের মধ্যে কোন পর্বটা আপনার ভালো লাগে বা কোনটা খারাপ?
মুহাম্মদ ইউনূস: খারাপ কোনোটাই না। খারাপটা বলব না, কিন্তু ভিন্ন। আগেরটা ছিল আমার নিজস্ব জগৎ। সারা জীবন ধরে যা যা করে এসেছি সেটার মধ্যেই ছিলাম। নিজস্ব আয়োজন, নিজস্ব চিন্তা। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সেটা আমার মত করে আমি ট্যাকল করেছি। আমি আমার মতো করে চলেছি। সেটা একেবারে আমার নিজস্ব জগৎ। এটা একবারে ভিন্ন জগৎ। এটা আমার নিজস্ব জগৎ না। এই জগতে আমি কোনো দিন ছিলাম না; থাকার কোনো আগ্রহও ছিল না। এটার ডান–বাম আমার জানা নেই। অনেকটা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলার মতো অবস্থা। কিন্তু এটারও একটা চ্যালেঞ্জ আছে।
আমাকে তাঁরা আহ্বান জানিয়েছে। প্রথমে একটু সংকোচ করছিলাম যে এতে যাওয়া ঠিক হবে না, যেহেতু আমি এ জগতের মানুষ নই। কিন্তু তাঁরা আমাকে বোঝাতে পেরেছে যে, এই পরিস্থিতিতে আপনার আসা দরকার। শেষ পর্যন্ত আমি রাজি হয়েছি যে, এইভাবে তোমরা প্রাণ দিয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ। আমার জন্য না হয় একটু চ্যালেঞ্জিং হলোই। কাজেই আমি রাজি হলাম। এটা ভিন্ন জগৎ। এই ভিন্ন জগতের মধ্যে এখন চলছি। দেখা যাক কত দূর যেতে পারি।
নূরুল কবীর: কিন্তু আগস্টের ৮ তারিখে এই জগৎটা যদি শুরু না হতো আপনার জন্য, পেছনের (আগের) যে চার মাস, আপনার মনে হয় তত দিনে জেলে থাকার কথা ছিল।
মুহাম্মদ ইউনূস: হয়তো, আমি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কোন কোন দেশে যাব যাতে বাংলাদেশে ফিরে যেতে না হয়। আমি এক উপলক্ষে আরেক দেশে ছিলাম। সেখানে বসে ভাবছি, এখন ফিরে যাওয়া ঠিক হবে কি না। কারণ, যাওয়ার সময় উত্তেজনা দেখে গেছি, কারফিউ দেখে গেছি। কারফিউর ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে; উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে।
নূরুল কবীর: তার মানে আপনি কারফিউ ভঙ্গ করেছিলেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি কারফিউ ভঙ্গ করে গেলাম, তা না হলে তো যেতে পারতাম না। ভাগ্যিস কেউ ধরেনি পথে। অত কড়াকড়ি কারফিউ ছিল না। ওই অবস্থা তো দেখে গেছি এবং এটা ক্রমাগতভাবে দেখেছি পত্রপত্রিকায় সোশ্যাল মিডিয়াতে ভয়ংকর রকম কাজ হচ্ছে। কাজেই ক্রমাগতভাবে ফিডব্যাকটা পাচ্ছিলাম। তার মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেল, একবারে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যে বুঝি নাই যে এর মধ্যে আমাকে জড়িত হতে হবে। আমাদের এর মধ্যে একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। কাজেই চার মাস এভাবেই গেছে আমার।
নূরুল কবীর: আপনি ৮ আগস্টে ক্ষমতাগ্রহণের পরে আপনার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের যে আইনগত অভিযোগ ছিল, সেগুলি কোর্ট থেকে একের পর এক উঠে যায়। আপনার পজিশনের ভারে কিংবা প্রভাবে এ ঘটনা ঘটেছে— লোকেদের এ রকম ভাবনার সুযোগ আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব এটা আমি সরকারে থাকি বা দেশে থাকি না থাকি— এগুলো এমনি চলে যেত। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছে আদালতে, আমাদের যে উকিলরা আছেন তাঁরা এটা বোঝাতে পারতেন যে এটার কোনো ভিত্তি নেই। এটার কোনো তথ্য নাই, কিছুই নাই। এগুলো খুবই ঠুনকো জিনিস ছিল। কাজেই এটা আমার জানা-অজানার কোনো বিষয় নয়। যেহেতু এটা বিচারের বিষয়, বিচারেই চলে যেত। আমি থাকলেও যেত, না থাকলেও যেত। ঘটনার চক্রে আমি ছিলাম।
নূরুল কবীর: কিন্তু লোকেরা যে বিচার ব্যবস্থার ওপর তৎকালীন এক্সিকিউটিভের, রাষ্ট্রের প্রভাবের কথা বলছিল বা বলাবলি আছে এখনো, তাহলে কি আপনি মনে করেন, উনারা ক্ষমতা থাকলেও কোর্ট ওইভাবেই ব্যবহার করত, মানে ন্যাচারাল পদ্ধতিতে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আগের যাঁরা ছিল তাঁরা তো করে নাই। করে নাই বলেই তো আমি আদালতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। যাঁরা এসেছে, তাঁরা বিচার চাচ্ছে, বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে।
নূরুল কবীর: সেভাবেই যদি চলতো তাহলে তো আপনি জেলে যাওয়ার একটা...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই। আমি তো জেলে যাওয়ার পথেই ছিলাম। [আদালতে] আসা যাওয়ার পথে প্রতিবারই মনে হচ্ছে, এবারই বোধ হয় জেলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে প্রস্তুতি নিয়ে গেছি যে হয়তো ফেরা নাও হতে পারে এবার। আমার সহযোগী যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের আত্মীয়-স্বজনকে বলে গেছে তাঁদের জন্য। আমি বলেছি, আমার কিছু করার নাই, যেমন আছে হবে। আমি আমার ফ্যামিলিকেও এ রকম প্রস্তুত করে যাইনি। বলি যে, রেখে দিলে রেখে দেবে, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আমি খুব সহজভাবে দেখছিলাম যে, এটা নিয়তির খেলা। এটা যেভাবে হবার হবে। এটাতে প্রস্তুতি নিয়ে আমার কোনো কাজ নাই যে জেলে থাকলে এই করতে হবে, করব। এটা যখন কপালে আছে, এটা আমাকে করে যেতে হবে।
নূরুল কবীর: আপনি এইমাত্র বললেন যে, এটা একটা ভিন্ন জগৎ এবং এইভাবে জড়িয়ে পড়তে হবে এ রকম একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায়, সেটা আপনি চিন্তা করেননি।
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: আপনি ২০০৭ সালে যখন একটা পার্টি করতে গিয়েছিলেন সেই সময় তো এটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিন্তা করেছিলেন। সেখানে যদি আপনি কনটিনিউ করতেন, আপনাকে তো রাজনৈতিক দায়িত্বই গ্রহণ করতে হতো।
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটার কারণ ছিল যে এখানে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না তখন, সবাই আমার বন্ধু-বান্ধব সহযোগী, পরিচিত। সবাই বলছে, আপনি কিছু একটা করেন; পেছনে লেগে রইল.. আপনি ছাড়া পারবে না কেউ, এই যা যা বলে আর কি আশপাশের লোকজন। এতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে শেষে বললাম যে ঠিক আছে আমি করব এইটা। পথে আসতে যেতে সাংবাদিকেরা ধরল। তখন আমি বলেছি, হ্যাঁ আমি করব। এই দিয়ে শুরু হলো। তখন বেশিরভাগ সময় আমি আসা যাওয়া করছিলাম বিভিন্ন জায়গায়, উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিলাম, চিটাগাং যাচ্ছিলাম। প্রত্যেকবার এয়ারপোর্টে এই কথাবার্তা হচ্ছিল। আর কোথাও না। তখন একসময় ধরল যে তাহলে কী নাম দেবেন? আমি (বললাম) যে নাম ঠিক করি নাই। নাম ঠিক করলে আপনাদের জানাব। তখন বলল, নাম ঠিক না করে কীভাবে যান? তখন অবশ্য একটা নাম দিলাম, নাগরিক শক্তি। তারপর বুঝলাম যে এটা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে জিনিসটা। তারপর সবাইরে বললাম যে এটার [ওপর] মতামত নাও। মতামত নেওয়ার ব্যাপারটি হলো, কোনোরকম এটা থেকে দূরে সরা যায় কি না তার চেষ্টা। নাম হলো, মতামত হলো। তারপর আমি দেখলাম যে ঢুকে যাচ্ছি এর ভেতরে। যখন দশ সপ্তাহ হলো প্রায়, তখন বললাম যে না ভাই আমি কোনো রাজনৈতিক দল করছি না, কিচ্ছু না। কাজেই আমার মাথার ভেতরে একদিন এই রাজনীতির মধ্যে দিয়ে গিয়ে ক্ষমতায় যাব, এ রকম কোনো পরিকল্পনা ছিল না, এটা দীর্ঘমেয়াদী জিনিস।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দল তো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত...
মুহাম্মদ ইউনূস: ছিল। কিন্তু তখন আমি তো আসলে রাজনৈতিক দল করতে চাচ্ছিলাম না। ঠেকা দেবার জন্য এগুলো বলে যাচ্ছিলাম। শেষে মনে করলাম যে, এটা বেশ গভীরে চলে যাচ্ছে। তখন একদম পরিষ্কার বলে দিলাম। তখন সবাই হতবাক হয়ে গেছে। তখন আমার বন্ধু-বান্ধব বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলেন।
নূরুল কবীর: আপনি কি আলাপ করেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে?
মুহাম্মদ ইউনূস: কিচ্ছু করিনি। সেজন্য আরও হতবাক হলো। বলে যে আপনি কিছু বললেন না আমাদের! আমরা আপনার পেছনে ঘুরলাম এত দিন ধরে।
নূরুল কবীর: মনঃক্ষুণ্ন হবার কথা...
মুহাম্মদ ইউনূস: খুবই মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে তাঁরা।
নূরুল কবীর: তাঁরা এখন কি আনন্দে আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: তাঁরা কাছে আসে না। বলে আবার কোন দিকে নিয়ে যায় আমাদের।
নূরুল কবীর: ওই নাগরিক শক্তির সঙ্গে ছাত্রদের যে নাগরিক কমিটি, তার কোনো চিন্তা বা ভাবনার সম্পর্ক আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: নাগরিক শব্দটা কমন আছে এটা দেখতেছি। আমার সঙ্গে তো আর কোনো আলোচনা হয় নাই, তাঁরা কোথা থেকে শব্দ পেল না পেল।
নূরুল কবীর: এই শব্দটা যে কোনো লোক ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আপনার সঙ্গে কোনো পরামর্শ করে নাই তাঁরা?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরামর্শ করে নাই।
নূরুল কবীর: আপনি প্রায়ই বলেন, কয়েকবারই বলেছেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে যে ছাত্ররা আপনাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে, তাঁদের ম্যান্ডেটের কারণে। ছাত্রসমাজ হিসেবে ৫ আগস্ট যে পরিমাণ তাঁরা সমন্বিত ছিল, সংগঠিত এবং একাকার ছিল, এইটা যদি বিভক্ত হয়ে যায় তাঁদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যাওয়ার পর, এই অর্থে যে ইমিডিয়েট উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন একটা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন। তার পতনের পরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন রাজনীতি আছে। তাঁরা যদি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে কিংবা তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত ঘটে, তখন আপনার ম্যান্ডেটটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আমি সেই সরকারের একটা অংশ। ওইটা হলো রাজনীতি। এই সরকারে আমি কত দিন আছি না আছি সেটা একটা ব্যাপার। ওরা কী করছে, রাজনীতির কী ফল দাঁড়াবে, সেটা ভিন্ন জিনিস। এটা একজন নাগরিক হিসেবে ওরা চিন্তা করতে পারে যে কী হবে না হবে। কিন্তু সরকার হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি; যতটুকু আমার সাধ্যে কুলায়।
নূরুল কবীর: আমার প্রশ্ন হচ্ছে ওটা সংঘবদ্ধ ছাত্র সমাজের ম্যান্ডেট ছিল। সেই সংঘবদ্ধতাটা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে...
মুহাম্মদ ইউনূস: দুর্বল হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: দুর্বল হয়ে যাবে?
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই দুর্বল হবে।
নূরুল কবীর: এ রকম সম্ভাবনা আপনি দেখেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় সম্ভাবনা তো থাকে। একটা দুর্বল হবে আরেকটা সবল হবে। এই টুকরা এই টুকরার সঙ্গে মিলবে। নানা রকম ঘটনাতো ঘটে।
নূরুল কবীর: অন্যান্য টুকরার কথা বলছেন। ধরুন আমরা যাঁরা বাইরে থেকে দেখি ওই অভ্যুত্থানে বিজয়ী ছাত্র নেতৃত্ব আপনাকে আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সেইটাকে সমর্থন করেছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা পাওয়ার কন্টেন্ডার তাঁরা আপনাকে সহযোগিতা ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাহলে আপনি যখন প্রায়ই বলেন, ছাত্ররা আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে, তখন আপনার কি মনে হয় যে অন্য দুইটা সেক্টর যাঁরা সংগঠিত, নানানভাবে, তাঁরা মনঃক্ষুণ্ন হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: হতে পারে। কিন্তু বাস্তব তো তাই। আমাকে তো ডেকে এনেছে ছাত্ররা। কাজেই আমি সেভাবেই বলেছি ছাত্ররা আমাকে নিয়োগ করেছে। এখন সবাই মিলে এটা সমর্থন করেছি আমরা। সেটা হলো বৃহত্তর একটা জিনিস। কিন্তু ইমিডিয়েট ছিল যে আমার সঙ্গে কথাটা হচ্ছে ছাত্রদের সঙ্গে। যাদের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নাই, জীবনে দেখিনি তাঁদেরকে, তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয়...সেভাবে আমি কথাটা জানিয়েছি। আমার বাস্তবটা জানিয়েছি। কাউকে মনঃক্ষুণ্ন করার জন্য কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য এঁরা দেয় নাই ওরা দিছে ওরকম কিছু না।
নূরুল কবীর: না মানে, পাওয়ার ব্লক থাকে তো...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই।
নূরুল কবীর: এই তিনটাই আপনার জন্য, দেশের মানুষের জন্য আপনার সরকারের অস্তিত্ব চলমান থাকার জন্য, জরুরি আমাদের মনে হয়।
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই, অবশ্যই।
নূরুল কবীর: আপনার এই যে প্রধান উপদেষ্টা পদের নাম, মানে নোমেনক্লেচার অব দি পজিশন এইটা আপনি এগ্রি করলেন কেন? আপনি কাকে উপদেশ দেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: ওগুলো আমার মাথায় আসে নাই। নামটা কি উপদেষ্টা হলো না কী হলো। দায়িত্ব নিতে বলেছে আমি দায়িত্ব নিয়েছি।
নূরুল কবীর: উপদেষ্টা হলো একটা পজিশন। উপদেষ্টা মানেই আপনি কাউকে উপদেশ দেন।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি এগুলোর ব্যাখ্যার মধ্যে যাই নাই। বলেছে আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে এই সরকারের। আমি দায়িত্ব নিয়েছি। নামটা কী দিল না দিল, কোথা থেকে আসলো...
নূরুল কবীর: একবারও মনে হয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এগুলো বড় মনে হয়নি। কারণ, বলেছে যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে এই ধরনের নামই হয়। কাজেই আমার চ্যালেঞ্জ করার কিছু নাই।
নূরুল কবীর: দুইটা ভিন্ন। একজন চিফ থাকে। চিফকে অন্যরা উপদেশ দেয়। তাহলে আপনি উপদেশদাতাদের মধ্যে প্রধান। কিন্তু কাকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা চিন্তা করি নাই।
নূরুল কবীর: আপনি যে মন্ত্রিপরিষদ (উপদেষ্ঠা পরিষদ) তৈরি করলেন ছাত্রদের আহ্বানে, অন্যদের সমর্থনে, সেইখানে কি আপনার মন্ত্রিপরিষদ গঠনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ছিল?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরিপূর্ণ বলব না, এটা তো তাৎক্ষণিকভাবে হয়েছে। এটা এমন কিছু না যে চিন্তাভাবনা করে করা হয়েছে। কাজেই আমাকে যতটুকু বলা হয়েছে, আমি সেটা করেছি। অন্য কারা কি করল, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
নূরুল কবীর: পরামর্শগুলি কি এসব সেক্টর থেকে এসেছে আপনার কাছে বা কোন রেকমেন্ডেশন সেটা আর্মি থেকে বা রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না না না। ওই রকমভাবে কিছু আসে নাই। বলছে যে এরা এরা আছে। আপনি কারে কারে নেবেন। শপথ গ্রহণ করতে হবে আগামীকাল বা সেদিনেই, এ রকম অবস্থা। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার পরিচিত যা নাম ছিল সেগুলো দিয়েছি।
নূরুল কবীর: আপনার কাছে এই খবর নিশ্চয়ই আছে বা আপনার এজেন্সিগুলো এই খবর কি দেয় যে আপনার সরকারের যারা সদস্য, তাঁদেরকে অন্তত দুটো ক্যাটাগরিতে জেনারেলি ভাগ করা যায়। এক পক্ষের ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে এনজিওস। সেখানে আপনার ব্যাপারে একটা সমালোচনা আছে যে চিটাগংয়ের লোক বেশি। কারণ আপনার বাড়ি চিটাগং? আরেক পক্ষ হচ্ছে, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই থেকে অনেকেই অনেক দূরে ছিলেন। এই তাঁদের কারণে এখন ঠিক স্টেটক্রাফট পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। এই কথাগুলো কি আপনার কানে আসে?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় বলাবলি করে, সবাই বলছে। কাজেই এখানে না আসার কোনো কারণ নাই। এজন্য বিব্রত হবারও কোনো কারণ নাই। সেভাবেই হয়েছে। নানা জায়গা থেকে আমরা এসেছি। আমারও তো কোনো অভিজ্ঞতা নাই। কাজেই ওদের দোষ দেব কী করে। আমাকে দেশ চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার তো বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা নাই। আমি তো কোনো দিন এ ধরনের কাজে ছিলাম না। আমি যদি পারি ওরাও পারবে এটাই আমার ভরসা ছিল।
নূরুল কবীর: তাঁদের পারফরমেন্স নিয়ে আপনার কেমন...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজের পারফরমেন্স নিয়েই আমার সন্দেহ। ওদের পারফরমেন্স নিয়ে কী জিজ্ঞেস করব।
নূরুল কবীর: কিন্তু আপনারটা তো অন্যরা বলবে...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব; আমি দেখছি তো।
নূরুল কবীর: আপনি কি আপনার পারফরমেন্স নিয়ে সন্তুষ্ট?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। বলছি যে আমার তো সেই কোয়ালিটি নাই, করার জন্য যেটুকু দরকার ওটুকু নাই। যদিও সাধ্যমতো করি, যদি লেগে যায় তো ভালো। না হলে আমাদের কপাল খারাপ।
নূরুল কবীর: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ থাকা দরকার বলে পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য যাদেরকে আমরা বলতে শুনি, সেই পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ আপনার আছে বলে মনে হয়? আমাদের কাছে মনে হয়, কিছুটা দূরত্ব আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার কাছে মনে হয় অবিশ্বাস্যরকম সমঝোতা-আত্মীয়তা-ঘনিষ্ঠতা আছে। এটা আমার কাছে অবাক লাগে। কাগজপত্রে দেখি তাঁরা একজনের বিরুদ্ধে একজন কটূ কথা বলে। যখন সামনে আসে, সবাই কী আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন! আমার কাছে অবাক লাগে এগুলো! মনে বড় সাহস লাগে। যখনই কথা বলি, ব্যক্তি হিসেবে যখন রাজনৈতিক দলের কারো সঙ্গে কথা বলি, অন্যরা কেউ নাই, একা সে। কিন্তু তার সঙ্গে যখন কথা বলি, কী রকম সমর্থন নিয়ে কথা বলে! আমি অভিভূত হয়ে যাই যে এত সমর্থন থাকা সত্ত্বেও এই দেশ চলছে না কেন! এর মধ্যে মাঝে মাঝে আবার কাগজপত্রে এ রকম কথাবার্তা [প্রকাশ] হয় কেন? এই দুরকম কেন?
নূরুল কবীর: কেন এমন হয় বলে আপনার মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয় এর একটা হলো রাজনৈতিক কথা। কিছু অঙ্গভঙ্গি আছে যেগুলো রাজনীতিতে চালু হয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে রাজনৈতিক নেতা বলে মনে হয় না। ওভাবে, ওই শব্দে কথা বলতে হয়; ওই সুরে কথা বলতে হয়। টেলিভিশনে গেলে ওই কন্ঠে কথা বলতে হয়। কিন্তু যেইমাত্র ব্যক্তি হিসেবে কথাবার্তা বলেন, তখন বলার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই সেটার আন্তরিকতা এবং সেটার ঘনিষ্ঠতা আমাকে অভিভূত করে। প্রতিবারই আমাকে অভিভূত করে।
নূরুল কবীর: একটা অন্য কথায় আসি। আপনার সরকার সেপ্টেম্বর মাসে সম্ভবত অক্টোবরে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাঁরা এই গণতন্ত্রের আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকটা পরিবারকে ৩০ লক্ষ করে টাকা দিবেন। পরবর্তীকালে জুলাই ফাউন্ডেশন হলো। সেখান থেকেও কথা এসেছিল যে আহতদের এক লক্ষ টাকা করে এবং পাঁচ লক্ষ টাকা করে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তরুণ-তরুণী, ধনী-গরিব ও মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে তাঁদেরকে দেওয়া হবে। আপনি নিশ্চয়ই সচেতন আছেন যে, সেই প্রতিশ্রুতি পালিত হয় নাই এখনো। এটা কেন? ইতিমধ্যে আপনারা হাজার কোটি টাকা করে বিভিন্ন ব্যাংকে দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় এক্সচেকার থেকে লুটপাটের কারণে যে সমস্ত ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁদের। কিন্তু যাঁরা এই ব্যবস্থাকে বদলাল তাঁদেরটা প্রায়োরিটিতে আসলো না কেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: প্রায়োরিটিতে ছিল বলেই এত কথা ঘোষণা হলো। প্রায়োরিটিতে ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি। এগুলো হলো আদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা। কীভাবে টাকা কার কাছ থেকে কোথায় যাবে? কীভাবে বিতরণ হবে? এগুলো নিয়ে। দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। যত টাকা লাগে তাঁদের, এই কমিটমেন্ট আছে এবং তাঁদের আমরা জীবৎকালে যত সমর্থন দরকার যত পয়সাকড়ি দরকার, সবকিছুর জন্য কমিটমেন্ট আছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই; টাকারও কোনো অভাব নাই।
নূরুল কবীর: কত দিন লাগতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এখন আমার আগাম বলতে ভয় ভয় লাগে। যে কথা বলি, ওটায় পারি না তো শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাতে।
নূরুল কবীর: আপনার কথায় আন্তরিকতা তো মানুষ বিশ্বাস করে। আপনার অনুমান? অন্তত এটা তো খুবই একটা ইমিডিয়েট এবং প্রায়োরিটির মধ্যে থাকার কথা।
মুহাম্মদ ইউনূস: নিশ্চয়ই।
নূরুল কবীর: এটা কি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে হচ্ছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। কার হাত দিয়ে কীভাবে যাবে, কার কাছ থেকে কোথায় যাবে, এগুলো নিয়ে গোলমাল হচ্ছে। আর কিছু না।
নূরুল কবীর: তাতে আমলাতন্ত্রের কিছু হচ্ছে না। কিন্তু সরকার আপনার সরকারের বদনাম হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের সবার সম্মিলিত ব্যর্থতা। আমি ব্যুরোক্রেসিকে (আমলাতন্ত্র) দোষ দেব না। তাঁদেরও নিয়ম কানুন আছে। আমরা হয়তো সে নিয়ম কানুন বুঝি না বলে কানেকশনটা ঠিকমতো করতে পারি নাই।
নূরুল কবীর: আপনার জন্য কোনো টাইমলাইন বলা কি কঠিন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি আবার মাস দিন একটা দিয়ে আবার বিব্রত হতে চাচ্ছি না আর কি।
নূরুল কবীর: সাম্প্রতিককালে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করছেন, আমরাও লক্ষ্য করছি যে সরকারের যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কর্মসূচি এবং নির্বাচন– এই দুটিকে পরিপূরক না ভেবে একটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে আলাপ–আলোচনার মধ্যে। এটা কি আপনাকে চিন্তিত করে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এখনো সাংঘর্ষিক তো যায় নাই। আমরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম, একটা ফর্মুলা দিয়েছিলাম, একটা প্রক্রিয়া তৈরি করেছিলাম। এটা কাজে লাগে কি না জানি না। প্রক্রিয়াটা হলো যে, কতগুলো কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। প্রত্যেকটা সাবজেক্টের ওপরে কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। এ রকম ১৫টা কমিশন হয়েছে। তার মধ্যে ৬টা কমিশন প্রথম ঘোষণা করেছিলাম। ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। তাঁরা ৯০ দিনে শেষ করতে পারে নাই। বলছে যে এক সপ্তাহ দেরি হতে পারে। সেটার কারণ আমাদের আয়োজন করতেও সময় লেগেছে। ঘোষণা করেছি, তাকে বসার জায়গা দিতে পারি নাই। কোথায় কে কার সঙ্গে পরিচয়, এসব করতে সময় লেগেছে। তাঁরা ৯০ দিন পায় নাই সেই হিসাবে। কাজেই যদি সাত তারিখে তাঁরা দিয়ে দেয় তাহলে জানুয়ারি ৭ তারিখের মধ্যে আমরা সেই ৬টা কমিশনের রিপোর্ট পাব। ওইখানে যাবতীয় সংস্কার সংক্রান্ত বিষয় দেওয়া থাকবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছে। তাহলে সংস্কারের রূপরেখাটা আমরা পেলাম। ইতিমধ্যে মতবিনিময় হয়েছে, তার মধ্যে কোনোটা টিকেছে, কোনোটা টিকে নাই। কমিশন মনে করেছে, যেটা এইগুলোই হলো আমাদের সারমর্ম। এগুলো পেয়ে গেলে তখন নিয়ে আসব বৃহত্তর সংলাপের জন্য। একটা সংলাপ সেদিন হয়েও গেল। যদিও কোনো রিপোর্ট আসেনি তবুও প্রাথমিকভাবে একটা সংলাপ হলো। সবাইকে নিয়ে আলাপ করা কোনটা পছন্দ, কোনটা অপছন্দ, কীভাবে অগ্রসর হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই বিষয়ভিত্তিক একটা বড় রকমের কনসেনসাস বিল্ডিং প্রসেস, যেটার জন্য আবার আলাদা একটা কমিশন ঘোষণা করলাম সেদিন। সেটা হলো এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের দিয়ে একটা কমিশন। আমি নিজে এটার চেয়ারম্যান হলাম এবং প্রফেসর আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করলাম যে আমরা মিলে এটা একটা কনসেনসাস ডেভেলপ করার চেষ্টা করব। এই কনসেনসাসের প্রক্রিয়াটা আমাদের ঠিক করতে হবে। সমাজের কোন কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে কীভাবে আদানপ্রদান হবে, তাতে একটা সর্বমত সম্মত একটা কিছু বের করা যায় কি না। সবকিছুতে একমত না হলেও অন্তত কিছু বিষয়ে আশা করি একমত হওয়া যাবে। তখন সেটা হবে আমাদের সংস্কার। যেহেতু একমত হয়ে গেছে তাহলে এটা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়ে যাবে— এইভাবে আমরা চিন্তা করছি।
নূরুল কবীর: এটা আবার কি মধ্য জানুয়ারিতে শুরু হতে পারে বলে মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: আশা করছি। ডেফিনেটলি।
নূরুল কবীর: অর্থাৎ আপনার সরকারের নিজস্ব কোনো সংস্কার কর্মসূচি নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: এইতো এটাই আমাদের।
নূরুল কবীর: কিন্তু এটাতো বাইরে থেকে আসল...
মুহাম্মদ ইউনূস: বাইরে থেকে নিয়েই তো আমাদের হলো। এটা এভাবে একজনের মাথা থেকে তো আসবে না। ১০ জনের মাথা থেকে এসে নির্যাস হয়ে এটা আসলো। তারপরও আবার সবার সঙ্গে আমি [কথা] বলছি।
নূরুল কবীর: আপনার কেবিনেটে আপনাদের কি কোনও নিজস্ব চিন্তাভাবনা কোন সেক্টরে...?
মুহাম্মদ ইউনূস: আছে। কিন্তু সেটা কমিশনকে গিয়ে বলতে হবে। কারণ মতো সংগ্রহ করার দায়িত্ব হলো কমিশনের।
নূরুল কবীর: কিন্তু সরকারের নিজেদের কোনো নিজস্ব...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজস্ব কোনো প্রোগ্রাম নাই। আমরা তো রাজনৈতিক দল না যে আমাদের একটা নিজস্ব থাকবে। আমাদের একেকজনের একেক মত। একেকজন একেক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সেটা নিয়ে তো আমাদের কোনো অসুবিধা নাই।
নূরুল কবীর: এগুলো নিয়ে অনেক ভিন্নমত কি আপনার সরকারের মধ্যে...
মুহাম্মদ ইউনূস: এখনো তো দেখি নাই। সামনে আসলে দেখা যাবে, যখন তর্ক-বিতর্ক শুরু হবে— না, এটা আমরা মানি না।
নূরুল কবীর: আর আপনি এটা অনুমান করছেন...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি অনুমান করছি। কারণ সব সময় সবাই যে একমত হবে সেরকম তো কথা নেই। যেমন ধরেন সেদিন সংলাপের জন্য আমাকে একটা বক্তৃতা দিতে বলেছিল। সেখানে বললাম যে সমঝোতা কীভাবে হবে। এটা একটা প্রক্রিয়া। বলতে গিয়ে বললাম, ধরুন আমি মনে করি ১৭ বছর বয়সে ভোটার হওয়া উচিত এবং আপনি সেটা ভিন্নমত পোষণ করেন। তাহলে আলাপ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আপনার মতই টিকে গেল। আমারটা হলো না। আমি মেনে নেব সেটা। লোকে মনে করল যে, ১৭ বছর— এটা সরকার থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি তো ভাই এ রকম বলি নাই। আমি বললাম যে ধরুন ১৭ বছর বয়স থেকে (ভোটার) হওয়া ভালো। এটা একটা মত।
নূরুল কবীর: সিদ্ধান্ত নয়...
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা সিদ্ধান্ত নয়। উদাহরণ হিসেবে এটা। তাহলে এটার সমঝোতাটা কীভাবে হবে? আপনাদের সবার মত একরকম, আমার মত একরকম। শেষ পর্যন্ত সবার মত যেদিকে, আমি সেদিকে যোগ দেব। সেটি হলো কনসেনসাস, সেটি হলো ঐকমত্য। এইভাবে আমরা অগ্রসর হতে চাই। সেটা অনেকে ভুল বোঝে। মনে করে যে সরকার থেকে ১৭ বছর লাগিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি বললাম যে না ভাই এ রকম তো বলি নাই আমি।
নূরুল কবীর: এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে, আমরা লক্ষ্য করছি, তরুণদের একটি অংশ যাঁরা নতুন একটা রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন, তরুণেরা যাঁরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁরা সময় নিতে চায় নির্বাচনের জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে যে সংস্কার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়াটা এগিয়ে আনা দরকার। কিন্তু তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে সাম্প্রতিককালে পাবলিক ডিবেটের মধ্যে এক ধরনের তিক্ততাও তৈরি হয়েছে। আপনার নজর এসেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: খুব ভালো করে নজর এসেছে।
নূরুল কবীর: সেটা একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয় কি?
মুহাম্মদ ইউনূস: মোটেই না। ওই যে বললাম বাইরে একরকম, ভেতরে আরেকরকম।
নূরুল কবীর: আচ্ছা, সে কারণে? তাঁরা শেষ পর্যন্ত একমত হয়ে যাবে?
মুহাম্মদ ইউনূস: একমত হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: তরুণেরা মনে করে, যাদের সম্পর্কে যেটা বলা আছে বা আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় যে তাঁরা দলটা করবে, দলের পরে কনসটিটিউয়েন্সিগুলি বিল্ড আপ করবে, লোকগুলি তৈরি করবে, এই কারণে তার সময় দরকার। আর ঠিক সংস্কারটা মাথায় আছে। নিশ্চয়ই তাঁরা সংস্কার চান। এই মুহূর্তে ক্ষমতার রাজনীতিতে তাঁরা প্রায়োরিটি দিচ্ছেন, তাঁদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে নির্বাচন করা। এ কারণেই অন্যরা মনে করে যে, শুধু অন্য একটা গ্রুপকে সময় দেওয়ার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তা আপনি সেটার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখছেন না।
মুহাম্মদ ইউনূস: সেজন্য ঘোষণা দিয়ে দিলাম। কতগুলো তারিখ দিয়ে দিলাম যাতে এই সন্দেহ না থাকে। কারণ যত কিছু টানতে চান না কেন আমি তো ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি। হয় এখানে হবে, না হয় ওইখানে। দুটো তারিখ দিয়ে দিয়েছি।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তারপরও বলছে যে আরও সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে; বাড়াতে চাচ্ছে না। এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে, কোন তারিখে করবেন। আমি বললাম যে, ওই প্রসেসটা অগ্রসর হতে আমরা দেখব। এটা তো আপনাকে বাদ দিয়ে দিলাম, এর বাইরে আমরা যাচ্ছি না, এইটা হলে এই পর্যন্ত, ওইটা হলে এই পর্যন্ত, এইভাবে আছে। কাজেই ওটা যে উনারা বুঝতেছে না তা (নয়), বোঝেন। তবু কথাটা বারে বারে বলছে যে, ইন কেইস আমরা এটা অতিক্রম করতে চাই।
নূরুল কবীর: তাহলে আপনাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চান।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের জন্য ভালো।
নূরুল কবীর: যাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চায়, তাঁরা আবার এটা ঠিকই বোঝে...
মুহাম্মদ ইউনূস: বুঝব তো বটেই।
নূরুল কবীর: দে আর প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারিজ...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরাও চাই যে চাপের মধ্যে থাকি। কারণ আমাদের ভেতরেও তো নানামতো থাকতে পারে।
নূরুল কবীর: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
মুহাম্মদ ইউনূস: সে জন্যই একটা বাঁধ দিয়ে দেওয়া হলো। এই পর্যন্তই, এর ভেতর থেকে আমাদের যা কিছু করতে হবে। এমন না যে কেউ বলে–না, পাঁচ বছর লাগবে। এটা সংস্কার করতে ভালো লাগছে না— এমন যেন বলতে না পারে। যে যা কিছু করতে হয় এর মধ্যে হতে হবে। এই সংস্কারের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, এই দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপেই করতে হবে, আরও ছয় মাস বাড়াতে হবে, বললাম যে না এর ভেতরেই সবকিছু করতে হবে। কাজেই এই যে একটা বাঁধ দেওয়াটা, এটা খুব দরকারি জিনিস আমাদের জন্য। এর মধ্যে আমরা যেন সবকিছু সম্পন্ন করতে পারি।
নূরুল কবীর: আপনার মন্ত্রিপরিষদের তরুণ সদস্যদের কেউ কেউ এই সব ব্যাপারে পাবলিক স্টেটমেন্ট করার পর অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন এবং সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে এ রকম কিছু স্টেটম