
এখনো বাজারে অস্তিত্বহীন জাতের মিনিকেট চালের নামে প্রতারণার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ভোক্তার পকেট কাটছে করপোরেট কোম্পানিগুলো। এ প্রতারণা প্রকাশ্যে চললেও প্রতিকারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি জুলাই বিপ্লবের ১০ মাস অতিবাহিত হলেও এ বিষয়ে সরকারেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজার সিন্ডিকেটে চালের অসাধু ব্যবসা ঠেকাতে বিগত আওয়ামী সরকারের সময় উচ্চ আদালতের কাছে একটি লিখিত পিটিশন করেছিল মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ‘মিনিকেট’ ও ‘নাজিরশাইল’ চাল প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারী সবগুলো রাইস মিলারের তালিকা দিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়।
চালের আকৃতি পরিবর্তন ও পলিশিংয়ের ফলে চালের পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে কি না এবং তা জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি কি না জানিয়ে চার মাসের মধ্যে একটি গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশও দেয় হাইকোর্ট। তা ছাড়া কম পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটি চাল তৈরি ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে সরকার কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে আদালত।
গতকাল শনিবার বিকাল হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর মনজিল মুরশেদ আমার দেশকে বলেন, বিগত সরকার হাইকোর্টের এ রুলের কোনো জবাব দেয়নি এবং কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি। ফলে আমরা বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে আবারও লড়ব। আশা করি দুই-এক মাসের মধ্যে শুনানি হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকারি গবেষণায়ও উঠে এসেছে, এটি একই সঙ্গে মানুষের সঙ্গে সুস্পষ্ট প্রতারণা ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এরপরও কী করে মিল মালিকরা গোটা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে। জনগণ প্রত্যাশা করেছিল জুলাই বিপ্লবের পর অন্তত এ বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আমাদের বোধগম্য নয়- সরকার কেন নীরব।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান আমার দেশকে বলেন, কোনো ভোক্তার কাছ থেকে মিনিকেট চালের ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। চালের মান বজায় রাখার বিষয়টি নিয়ে খাদ্য বিভাগ কাজ করে। এ ছাড়া রাইস মিল মালিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের আছে।
গতকাল শনিবার বিকালে এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, আমি আপনার প্রশ্ন বুঝতে পেরেছি, তবে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করা ঠিক হবে না। জেনেশুনে পরে এ বিষয়ে কথা বলতে পারব।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) নির্বাহী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিগত সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মিনিকেট চাল বাজারজাত করা নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। কিন্তু বাজার সিন্ডিকেটের কারণে সেটি আর কার্যকর করতে পারেনি। প্রকাশ্যে গোটা জাতি কিছু কোম্পানির মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে।
রাজধানীর বাবুবাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, কারওয়ানবাজারসহ কয়েকটি চালের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় চালের নাম মিনিকেট। দেখতে ঝকঝকে ঝরঝরে অপেক্ষাকৃত সরু ও চিকন এ চালের দাম বেশি হলেও ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে। বাস্তবে মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাতের অস্তিত্ব না থাকলেও মিনিকেট চালে বাজার সয়লাভ।
এদিকে মিনিকেট চালের নামে সস্তা চাল বেশি দামে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ লাভ করছেন মিলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মিল মালিকরা ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ জাতের ধান থেকে পাওয়া চাল দিয়ে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল তৈরি করছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এই দুটি জাতের ধানই সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। সাধারণত ৫৫-৬০ টাকা কেজি দরে এই চাল বিক্রি হয়। অন্যদিকে, বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি।
মিনিকেট চাল নিয়ে খোঁজখবর ও গবেষণার জন্য গত কয়েক বছরে সরকার বেশকিছু কমিটি গঠন করলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে বন্ধ হয়নি চালের এই অসাধু ব্যবসা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা, খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ইউনিট (এফপিএমইউ) ২০২০ সালে একটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, আধুনিক অটো রাইস মিলের মালিকরা মেশিনের মাধ্যমে চালের আকার পরিবর্তন করেন এবং পলিশ করে চালকে চকচকে রূপ দেন। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘রাইস মিলিং’। ফলে কোন চাল কোন ধান থেকে আসছে তা বোঝার কোনো উপায় থাকে না ক্রেতার।
দেখতে চিকন ও চকচকে হলেও রাইস মিলিংয়ের সময় চালে বিদ্যমান প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের মতো পুষ্টিগুণগুলো চলে যায়।
এফপিএমইউ প্রকাশিত ২৫ পৃষ্ঠার ওই গবেষণাতে বলা হয়, ‘যেহেতু রাইস মিলিং বা চালের আকার-আকৃতি বদলানো এবং ব্র্যান্ডিং নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই; তাই তারা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করে যাচ্ছে এবং ক্রেতাদের এই চাল কিনতে বাধ্য করছে।’ এদিকে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের নামে অন্যান্য জাতের চাল বিক্রি করার কথা স্বীকার করেছেন রাইস মিলাররা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মিল মালিক বলেন, বাজারে মিনিকেটের প্রচুর চাহিদা থাকায় এই পন্থা অবলম্বন করেন তারা। এমনকি কখনো কখনো চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খেতে হয় তাদের।