
শহীদ মো. মোস্তফার জন্ম খুবই দরিদ্র পরিবারে। ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্নে ২০২২ সালে গাজীপুর আনসার ভিডিপি একাডেমির পাশে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। কাজের পাশাপাশি লেখাপড়াও চালিয়ে যান।
২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৬৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ইচ্ছা ছিল জায়গা-জমি কিনে পাকা বাড়ি নির্মাণ করে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবেন। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আনসার সদস্যদের গুলিতে ২২ বছর বয়সি এই তরুণের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
শহীদ মো. মোস্তফার বাড়ি জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার কড়ইচড়া ইউনিয়নের ধলিরবন্ধ এলাকায়। বাবা মো. স্বপন মিয়া গাজীপুরেই একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। মা মর্জিনা বেগম গৃহিণী। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা মোস্তফা ছোট থেকেই খুবই মেধাবী ছিলেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ২০২৩ সালে কড়ইচড়া ইউনিয়নের মহিষবাথান এলাকার মেয়ে মুন্নাকে বিয়ে করেন মোস্তফা।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আনসার ভিডিপি একাডেমি এলাকায় যোগ দেন মোস্তফা। সে দিন আনসার সদস্যরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ও টিয়ারশেল ছোড়ে। আন্দোলনে আনসার সদস্যদের ছররা গুলি মোস্তফার পিঠে লেগে রাস্তার পাশে ঝোপের মাঝে লুটিয়ে পড়েন তিনি এবং সেখানেই শহীদ হন।
এদিকে দুপুর থেকে মোস্তফাকে খুঁজে না পাওয়ায় তার বাবা বারবার ফোনে কল করলেও কেউ রিসিভ করেনি। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে রাস্তার পাশে ঝোপে পড়ে থাকা মোস্তফার লাশের প্যান্টের পকেটে মোবাইল ফোনে রিংটোন বেজে ওঠে। পরে এক পথচারী ফোন রিসিভ করে জানান, মোস্তফা শহীদ হয়েছেন। সে দিনই মোস্তফার বাবা সেখান থেকে তার লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় গত বছর ২৮ নভেম্বর গাজীপুর কোর্টে বাবা স্বপন মিয়া বাদী হয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন।
স্বামীকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন স্ত্রী মুন্না। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন মোস্তফার ছোট ভাই মেহেদী হাসান (১১) ও নুর আলম (৪)। কান্না থামছে না শহীদ মোস্তফার মা মর্জিনা বেগমের। ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
মর্জিনা বেগম বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে মোস্তফার পিঠে গুলি লাগে, সে শহীদ হয়েছে। বারবার আমার ছেলের ছবি চোখে ভেসে ওঠে। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা খুবই গরিব। আমার ছেলে আমাদের পাশে দাঁড়াইছিল। মোস্তফা আমাদের সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখাইছিল। জমি কিনব, পাকা বাড়ি করব। আমার ছেলের মনের আশা পূরণ হলো না। আল্লাহর আমার ছেলেরে পছন্দ হয়েছিল, নিয়া গেল।’
মোস্তফার বাবা স্বপন মিয়া বলেন, “শহীদ হওয়ার দুদিন আগে মোস্তফা ফোন করে বলে, ‘বাবা ভালোভাবে চলাফেরা করতে হবে, নামাজ পড়তে হবে। ছোট ভাই দুইটারে বড় আলেম বানাবেন। আমাদের জুতজমা (জমি-জমা) নাই, আপনি কষ্ট করে লেখাপড়া করাইছেন। ধৈর্য ধরেন, অল্প দিনেই আমরা উপরে উঠে যাব। আপনার আর কষ্ট করা লাগবে না; বাড়িতে থাকবেন আর আল্লাহর ইবাদত করবেন।”
এ সময় আক্ষেপ করে স্বপন মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলের স্বপ্নগুলো ধূলিসাৎ করে দিয়েছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। মামলা করছি ওই খুনিদের নামে; খুনিগুলোর যেন হয় ফাঁসি হয়।’