
দেশে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে ; বিশেষ করে রাজধানীর বাইরে । চলতি বছর দেশে সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনায় । গ্রামাঞ্চলে সাধারণভাবে বাস করা অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশাও ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী হয়ে উঠেছে । একই সঙ্গে সেখানে বিস্তার ঘটেছে শহর থেকে যাওয়া এডিস ইজিপ্টাই মশার । এতে গ্রামে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি বেড়েছে । ডেঙ্গুবাহী মশার অভিযোজন সক্ষমতাও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা । কীটতত্ত্ববিদদের তথ্য অনুযায়ী , শহরাঞ্চলে এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির মশা বেশি থাকে । নগরের বাসিন্দারা ভাইরাসবাহী এই মশার মাধ্যমেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় । আর গ্রামাঞ্চলে থাকে অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশা । বন ও ঝোপঝাড়ের মতো প্রাকৃতিক উৎসে এদের আবাস ।
এই দুই প্রজাতির মশার ডিম পাড়া তথা বংশ বিস্তারের স্থান আলাদা । কিন্তু গ্রামের মশাগুলোও ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এটি ছড়িয়ে দিচ্ছে । গ্রামের মানুষের শহরে যাতায়াত এবং শহরের বিস্তারের কারণে গ্রামেও ইজিপ্টাই মশা দেখা যাচ্ছে । উভয় ধরনের মশার উপস্থিতির কারণে গ্রামাঞ্চলে এখন ডেঙ্গু রোগী বেশি । চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশে ৬ হাজার ৪৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে । এদের মধ্যে মারা গেছে ৩০ জন । চলতি বছরে ডেঙ্গু রোগীদের ২৩ শতাংশ রাজধানী ঢাকায় চিকিৎসা নিয়েছে । আর বাকি ৭৭ শতাংশই রাজধানীর বাইরে । এককভাবে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে বরিশাল বিভাগে । দক্ষিণাঞ্চলের এই বিভাগে এ পর্যন্ত রোগী ২ হাজার ৯৮০ জন । এর মধ্যে বরগুনায় ১ হাজার ৮৩২ ও বরিশাল জেলায় ৫৭৫ জন । রাজধানীতে ১৭ জন আর রাজধানীর বাইরে ১৩ জন মারা গেছে । শুধু বরিশাল বিভাগেই ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে । বরগুনার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ রোগের প্রাদুর্ভাব এখানে কেন বেশি তার সুনির্দিষ্ট কারণ আইইডিসিআর বলতে পারবে । আমাদের মনে হচ্ছে , জলবায়ুর পরিবর্তন একটা কারণ হতে পারে । লবণাক্ত পানিতেও মশা অভিযোজন করে নিচ্ছে । এ ছাড়া লোকজনের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে । ’
সিভিল সার্জন কয়েক মাস ধরে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি না থাকায় মশকনিধন কার্যক্রম ভালোভাবে না চলার কথাও বলেন । তিনি বলেন , বরগুনার পয়োনালা ব্যবস্থা ( ড্রেনেজ সিস্টেম ) অপরিকল্পিত । মশা নির্মূলে ওষুধ ছিটালেও কিছু সময় পরে পরিস্থিতি আগের মতোই হয়ে যায় । ’ সরকারের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায় , ২০১৯ সালে প্রথম রাজধানীর বাইরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী দেখা যায় । রাজধানীর বাইরেই বেশি রোগী দেখা যায় ২০২৩ সালে । ২০১৯ সালে মোট রোগীর ৪৯ শতাংশ ছিল রাজধানীর বাইরে । এর পর থেকে ২০২১ সালে ১৭ শতাংশ , ২০২২ সালে ৩৭ শতাংশ , ২০২৩ সালে ৬৬ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ৬০ শতাংশ রোগী রাজধানীর বাইরে পাওয়া যায় । সরকারের ডেঙ্গুবিষয়ক পরিসংখ্যান মূলত নির্ধারিত কিছু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি । এর বাইরে সারা দেশে বহু হাসপাতালে রোগী থাকলেও তাদের তথ্য নেওয়া হয় না । অনেকে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে থাকছে , কেউ কেউ মারাও যাচ্ছে , সে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকছে ।
রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গুর বিস্তার সম্পর্কে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ( নিপসম ) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড . মো . গোলাম ছারোয়ার আজকের পত্রিকাকে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন । তিনি বলেন , “ এডিস ইজিপ্টাই ও অ্যালবোপিকটাস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে । ইজিপ্টাই শহর এবং অ্যালবোপিকটাস গ্রামাঞ্চলের মশা । অ্যালবোপিকটাস মশা বন- জঙ্গল , বাঁশের ঝাড় , গাছের বাকলের মতো স্থানে থাকে । এ মশা আগে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল না । এখন তারাও ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে । আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীকে কামড় দিয়ে তারাও ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে । একই সঙ্গে নগরে ডেঙ্গু ছড়ানো ইজিপ্টাই মশা যেকোনোভাবে গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করেছে ।
এখন দুই প্ৰজাতি মশাই সমান তালে ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে । এ ছাড়া বিরূপ পরিবেশেও টিকে থাকার ( অভিযোজন ) সক্ষমতা তৈরি করছে এসব মশা । ’ ড . গোলাম ছারোয়ারের মতে , ডেঙ্গু প্রতিরোধে সঠিক ‘ কন্ট্রাক ট্রেসিং ’ ( রোগী ও তার অবস্থান শনাক্ত করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ) অতি জরুরি । কিন্তু এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে মশা নির্মূলের উদ্যোগ নেই । সে কারণে অন্য কোনো অঞ্চল থেকে আক্রান্ত হয়ে এলেও রোগী যেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে , সে জায়গা তালিকায় থাকছে । এতে আক্রান্ত মশাকে আড়াল করে তাদের বংশ বিস্তারের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে । ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ এবং সংক্রমণ কমাতে করণীয় সম্পর্কে রোগতত্ত্ব , রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ( আইইডিসিআর ) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা . মুশতাক হোসেন বলেন , “ চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন । আর হাসপাতালে ভর্তির বাইরেও প্রচুর রোগী রয়েছেন , যাঁদের শনাক্ত করা হচ্ছে না । সঠিক রেকর্ড রাখতে হবে । প্রতিরোধ কার্যক্রমের ঘাটতি এ রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ । ’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ( সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ) অধ্যাপক ডা . মো . হালিমুর রশিদ বলেন , ‘ ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি নেই । প্রতিরোধের কাজটি স্থানীয় সরকার বিভাগের । তাদের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে । ’