
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারগুলোর স্থায়ী বসবাসের জন্য ফ্ল্যাট দেবে সরকার। এজন্য রাজধানীর মিরপুরে একটি পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়েছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। এর আওতায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ৮০৪টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে। নির্মাণের পর প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ৯৫ লাখ টাকা; শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে নির্মিত এ ফ্ল্যাটগুলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাবে তাদের পরিবার। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে ৭৬১ কোটি টাকা।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে ‘৩৬ জুলাই’ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হয়। প্রকল্প প্রস্তাব সূত্রে জানা গেছে, আলোচ্য প্রকল্পটি মিরপুর হাউজিং এস্টেটের ১৪ নম্বর সেকশনে মিরপুর পুলিশ লাইন্স সংলগ্ন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জমিতে বাস্তবায়ন করা হবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রস্তাবিত প্রকল্প এরই মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। অনুমোদন পেলে চলতি বছরের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ফ্ল্যাট নির্মাণ কার্যক্রম শেষ হবে ২০২৯ সালের জুনে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪-এর নির্ভীক শহীদদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্ৰদৰ্শন, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ৩০৭.৩৪ কাঠা জমির ওপর শহীদ পরিবারদের জন্য ১ হাজার ৩৫৫ বর্গফুট আয়তনের ৮০৪টি আবাসিক ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে বিনামূল্যে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত আবাসিক ফ্ল্যাট প্রদানের ক্ষেত্র তৈরি করা।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে শহীদদের পরিবারের পুনর্বাসন এবং স্থায়ী বাসস্থানের জন্য বিনামূল্যে ফ্ল্যাট প্রদানের নিমিত্তে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সরকারি অর্থায়নে এ প্রকল্পের মাধ্যমে শহীদ ব্যক্তিদের পরিবারের পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে এবং তাদের জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।
প্রকল্প প্রস্তাব সূত্রে জানা গেছে, ‘৩৬ জুলাই’ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পে আওতায় ছয়টি ১৪তলা এবং ১২টি ১০তলাবিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। এসব ভবনে থাকবে মোট ৮০৪টি আবাসিক ফ্ল্যাট, প্রতি ফ্ল্যাট হবে ১ হাজার ৩৫৫ বর্গমিটার। নির্মাণকাজ শেষে ফ্ল্যাটগুলো জুলাই শহীদ পরিবারগুলোর মধ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বিতরণ করা হবে। নির্মাণের পর আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য দাঁড়াবে ৯৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।
৭৬১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ভবনগুলোতে উন্নত মানের স্যানিটারি ও বৈদ্যুতিক ফিটিংস, লিফট, জেনারেটর, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থা, সোলার প্যানেল, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় কমিউনিটি ভবন, খেলার মাঠ, বহির্বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ড্রেন, কালভার্ট ও নিজস্ব গভীর নলকূপ স্থাপনাসহ যাবতীয় সম্ভাব্য সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
এদিকে গত সোমবার জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় প্রকল্পটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশনের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবারদের জন্য স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই চলছে। প্রকল্প প্রস্তাবে কোনো অসংগতি আছে কি না, সেটা দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে পিইসি সভা হয়েছে। সব ঠিক থাকলে একনেকে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হবে।
পিইসি সভা সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আরএডিপিতে অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নেই। তবে প্রকল্পটি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে জমির মিউটেশন, উচ্ছেদ কার্যক্রম, ভবন নির্মাণ, আরসিসি সীমানা প্রাচীর, প্রধান গেট, বৃক্ষরোপণ, বেড লিফট স্থাপন।
অন্যদিকে, আলোচ্য প্রকল্পের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সম্মান জানাতে এবং পুনর্বাসনের জন্য আরও সাতটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ছয়টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ উদ্যোগগুলো আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পগুলোর মূল লক্ষ্য শহীদ ও আহতদের বাসস্থান, আহতদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা গড়ে তোলা, মানসিক পুনরুদ্ধার এবং আন্দোলনের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করা। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।
জুলাই আহত ও শহীদদের জন্য নেওয়া অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘আন্দোলনে ভুক্তভোগীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও আত্মনির্ভরতা’ শীর্ষক প্রকল্প। ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নারীদের জন্য পৃথক সহায়তা প্রকল্প, জুলাই আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণে ৯৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই প্রকল্প, ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে আত্মনির্ভরতা ও কর্মসংস্থান প্রকল্প, ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিফলক স্থাপন প্রকল্প।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, উদ্যোগ ভালো, এ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে যেভাবে অবকাঠামো নির্মাণে বিশাল বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেখানে মানবসম্পদ উন্নয়ন, দক্ষতা তৈরির মতো টেকসই উপায়ে খরচ করাটাই আরও জরুরি ছিল। পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে সেগুলো অনুমোদন ও বাজেট বরাদ্দ ছাড়াই সরাসরি এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।
এ বিষয়ে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নূরুল বাসির কালবেলাকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। নামের তালিকা অনুযায়ী নিহত পরিবারকে ফ্ল্যাট দেওয়া হবে। তবে এর মধ্যে অনেকে গ্রামে নিহত হয়েছেন। তারা হয়তো ঢাকায় ফ্ল্যাট নাও নিতে পারেন। তাই নিহতদের গেজেটের তালিকা থেকে কিছু কম ফ্ল্যাট করা হচ্ছে। প্রয়োজন হলে আবার নতুন করে ফ্ল্যাট করা হবে। যে জমিতে ফ্ল্যাট করা হবে, সেটা গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের।