
দেশে বৃষ্টিপাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। কেবল জুনের ১৭ দিনে রোগী পাওয়া গেছে ২ হাজার ১২১ জন, আর মারা গেছেন ৭ জন। মে মাসের তুলনায় এই সংখ্যা কিছুটা বেশি। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩০ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৪৬৬ জন। একইসঙ্গে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে করোনাও। প্রতিদিনই মিলছে রোগী, সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের বেশি। তবে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, করোনা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু এখনও হয়নি।
চারদিন আগে বরগুনার সাফওয়ান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। প্রথমে তাকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে পথে রবিবার (১৫ জুন) সন্ধ্যা ৭টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সেই সাফওয়ান মারা যান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, মে মাস থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাড়তে শুরু করেছে। পুরো মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আর মারা গেছেন ৭ জন। এর আগে জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। একইসঙ্গে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ৭ জন, মে মাসে ৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকেই ঢাকার বাইরে বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা গেছে। এ বছর এখন পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪২ জন পাওয়া গেছে বরিশাল বিভাগে সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে, যা মোট রোগীর প্রায় ৪৪ শতাংশ। এছাড়া চট্টগ্রামে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯৪৫ জন, ঢাকায় (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৯৩ জন, খুলনায় (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৮১ জন, ময়মনসিংহে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১০৪ জন, রাজশাহীতে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯৮ জন, রংপুরে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২২ জন এবং সিলেটে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫১৯ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮৯৭ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
রাজধানীতে এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যুর অর্ধেকই হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়। ওই এলাকায় এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ জন। এছাড়া উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১ জন, বরিশালে ৭ জন, চট্টগ্রামে ৩ জন, ঢাকায় ১ জন, খুলনায় ২ জন এবং ময়মনসিংহে ১ জন মারা গেছেন।
হাসপাতালের তথ্য বলছে, ঢাকার ৫টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী আছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এবং ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি।
এছাড়া ঢাকার বাইরে কুমিল্লা, বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ, পটুয়াখালী এবং বরগুনায় বেশি হারে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ জানান, কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে।
তিনি বলেন, চিকিৎসা দিয়ে ডেঙ্গু নির্মূল করা সম্ভব নয়। এজন্য এডিস মশার আবাসস্থল ধ্বংস করতে হবে। জেলাজুড়ে ব্যাপক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে। পাশাপাশি মশক নিধন অভিযান আরও জোরদার করতে হবে।
ডেঙ্গু বৃদ্ধির পেছনে মশক নিধনে পর্যাপ্ত কার্যক্রম না থাকাকে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বরিশাল ও ঢাকায় বেশি। এটি দোষারোপের জন্য বলছি না। মশক নিধনে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের যেভাবে ব্যস্ত থাকার কথা, দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার কথা—সেটি অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত মাত্রায় করা হয়নি। ফলে মশক নিধন কার্যকর হয়নি।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমাদের গাইডলাইনও আপডেট করা হচ্ছে। আজকালের মধ্যে সেটি দেওয়া হবে।
বাড়ছে করোনার সংক্রমণও
ডেঙ্গুর পাশাপাশি জনমনে উদ্বেগ আছে করোনা ভাইরাস নিয়েও। নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ১৬ দিনে ১৫২ জন করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। আর করোনায় এই সময়ের মধ্যে মারা গেছেন ৫ জন।
অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে যে পরিমাণ করোনা রোগী এবং পরীক্ষার যে হার, তাতে বোঝা যাচ্ছে— মানুষের মধ্যে সেই মাত্রায় লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু এখনও দেখছি না।’
তিনি বলেন, ‘রোগ নির্ণয়ে আমাদের কার্যক্রম চলমান। তিনটি মাধ্যমে আমরা করোনার নমুনা পরীক্ষা করছি। চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতাল ও বিভিন্ন হাসপাতালে ডেডিকেটেড ইউনিট করেছি। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বর্তমান প্রস্তুতি রোগীর চাপ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী যথেষ্ট মনে করি।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগকে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব অঞ্চলে রোগী বেশি, তাদের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগকে পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করতে হবে। না হলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘দেশে একসঙ্গে বিভিন্ন ভাইরাস বেড়ে যাচ্ছে। করোনা, ডেঙ্গু, ডায়রিয়াসহ কয়েকটি ভাইরাসে এই সময়ে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কোনটা করোনা, কোনটা ডেঙ্গু—তা জনসাধারণ বুঝে না। এ জন্য প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ ভয় পেয়ে যায়। তবে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, সচেতন হতে হবে। লক্ষণ দেখা দিলেই পরীক্ষা করতে হবে। সেইসঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।’