
নিয়ম না মেনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) নিয়োগের অভিযোগ পুরনো। এবার সেটি উঠে এলো একটি প্রতিবেদনে। অন্তত ৪৪ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই। যাদের মধ্যে ৩৪ জন পাচ্ছেন অতিরিক্ত বেতন-ভাতা। সবমিলিয়ে এই কর্মকর্তাদের পেছনে সরকারের ৫১ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
আওয়ামী লীগ আমলে ইউজিসি’র একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে। তারা ইচ্ছেমতো ছড়ি ঘুরিয়েছেন। নিজেরা দুর্নীতির পাশাপাশি সায় দিয়েছেন নানা অপকর্মে। অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা পাওয়া এই ৩৪ কর্মকর্তা প্রাপ্য ভাতার চেয়ে ২৫/৩০ হাজার টাকা অতিরিক্ত পাচ্ছেন। তাদের বেতন-ভাতা ও অবসরকালীন সুবিধায় একেকজন পাবেন প্রায় দেড় কোটি টাকা। ফলে সরকারের অপচয় হবে প্রায় ৫১ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে বেশ কিছু ব্যক্তি নানা সুবিধা পান। গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেকেই নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে ফের পদোন্নয়ন নেন। ইউজিসি’র প্রবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন করে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়ে অনেকেই হয়ে যান তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইউজিসিতে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রথমশ্রেণির পদে উন্নীতকরণের প্রক্রিয়াটি শুরু হয় দুটি অফিস আদেশের মাধমে; ২০০৪ এবং ২০০৮ সালে। এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর ইউজিসি’র পূর্ণ কমিশন সভায় নিয়োগ, পদোন্নয়নে অনিয়ম উদ্ঘাটনে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি নথিপত্র পর্যালোচনা করে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৪ এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১০ জন এবং ৩৪ জন ২য় শ্রেণির কর্মকর্তাকে ইউজিসি’র সার্ভিস রুলের নির্ধারিত যোগ্যতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রথমশ্রেণির পদ দেয়া হয়। তা ভূতাপেক্ষ (২য় শ্রেণির ১০ গ্রেডের পদে যোগদানের তারিখে) অনুমোদন দেয়া হয় যা কমিশনে বিদ্যমান নিয়ম পরিপন্থি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর পদোন্নতি বা পদোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বৈষম্যের শিকার হয়েছেন কিনা, তা পর্যালোচনার জন্য গত বছরের ২৩শে অক্টোবর ইউজিসি সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ২৮শে অক্টোবর ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। কিন্তু ৪ঠা নভেম্বর ইউজিসি সচিবকে আহ্বায়ক করে পুনরায় ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয় এবং পূর্বের ২টি আদেশ বাতিল করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক মো. রেজাউল করিম হাওলাদার এবং উপসচিব (লিগ্যাল) নুরনাহার বেগম শিউলী। কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী গত জানুয়ারিতে ৩৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নয়ন দেয়া হয়। কিন্তু এই পত্রে বলা হয়, মো. রেজাউল করিম হাওলাদার ২০১৯ সালে নিজের এলাকায় মসজিদের নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রামাণিত হবার পর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের ২৯শে জানুয়ারি ইউজিসি’র পূর্ণ কমিশনে গোলাম মোস্তফা, সুলতান মাহমুদ, সুরাইয়া ফারহানা, মোস্তাফিজার রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, মুহিবুল আহসান, আকরাম আলী খান, রোকনুজ্জামান, আ. মান্নান, মাসুদ হোসেন, নাজমুল ইসলাম এবং শের আলী সাবরীকে অতিরিক্ত পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, সুরাইয়া ফারহানা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ৩৩ বছর বয়সে ২০০৩ সালে এডহক ভিত্তিতে কম্পিউটার অপারেটর পদে ইউজিসিতে যোগদান করেন। যদিও সে সময় চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ৩০ বছর। তিনি যুক্তরাজ্যে পড়তে যাওয়ার জন্য শিক্ষা ছুটিতে যান। কিন্তু দুই বছর কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি ছাড়াই দেশে ফেরেন। গোলাম মোস্তফা, সুলতান মাহমুদ, মোস্তাফিজার, মোস্তাফিজুর, মুহিবুল, আকরাম ও মান্নান ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির শাখা কর্মকর্তা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৮ সালের ২১শে অক্টোবর এক আদেশে সুরাইয়া ফারহানা ও এই ৭ জনসহ মোট ৩৪ জন কর্মকর্তার পদ তাদের যোগদানের তারিখ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। এসব কর্মকর্তারা বিগত সরকারের আমলে প্রত্যেকেই আরও দুটি করে পদোন্নয়ন পেয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী সরাসরি নিয়োগ ব্যতীত ৯ম গ্রেডে উন্নীত করার কোনো সুযোগ নাই।
যোগ্যতা ছাড়াই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপপরিচালক হয়েছেন মো. জামাল উদ্দিন। জামাল উদ্দিন সম্পর্কে ইউজিসি’র ১৫৬তম পূর্ণ কমিশন সভায় নিয়োগ, পদোন্নয়নে অনিয়ম উদ্ঘাটনে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির মতামতে বলা হয়েছে, মো. জামাল উদ্দিনকে শাখা কর্মকর্তা পদে ৫১০০-১০৩৬০ টাকা বেতন স্কেলে ১৭ই জানুয়ারি ২০০৭ সালে নিয়োগ প্রদান করা হয়। কিন্তু নিয়োগের বয়স ৩২ বলা হলেও এ সময় তার বয়স ছিল ৩৯ বছর ১০ মাস ২২ দিন।
অন্যদিকে গোলাম মোস্তফা, সুলতান মাহমুদ, মোস্তাফিজার, মোস্তাফিজুর, মুহিবুল, আকরাম ও মান্নান ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির শাখা কর্মকর্তা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৮ সালের ২১শে অক্টোবর এক আদেশে সুরাইয়া ফারহানাসহ মোট ৩৪ জন কর্মকর্তার পদ তাদের যোগদানের তারিখ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। যা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ‘অনিয়ম ও অযৌক্তিক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে যোগদানের তারিখ থেকে ভূতাপেক্ষভাবে তাদের চাকরি প্রথমশ্রেণির চাকরি হিসেবে গণ্য করা হয়। এসব কর্মকর্তারা বিগত সরকারের আমলে প্রত্যেকেই দুটি করে পদোন্নয়ন পান।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু অবৈধ অফিস আদেশের কারণে ৩৪ জন কর্মকর্তা যারা বর্তমানে উপ-পরিচালক থেকে অতিরিক্ত পরিচালক পদে চাকরি করছেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাদের পদোন্নয়ন হলে ১০ বছর ও ১৬ বছর চাকরি সমাপনান্তে দুটি উচ্চতর গ্রেড পেয়ে বেতন স্কেলের ৮ম গ্রেড প্রাপ্ত হতেন। সে ক্ষেত্রে চাকরি জীবনের শেষদিকে বর্তমান বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে বেতন পেলেও তা ৫৫ হাজার ৪৭০ টাকা হতো। অথচ অবৈধ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে তাদের কেউ কেউ এখন বেতন পাচ্ছেন ৭৪ হাজার টাকা স্কেলে। প্রত্যেক কর্মকর্তা প্রতিমাসে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত বেতনের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন সরকারি কোষাগার থেকে বেশি নিচ্ছেন। চাকরিজীবনে বেতন ও চাকরিকাল শেষে পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ একজন কর্মকর্তা কমপক্ষে দেড় কোটি টাকার অতিরিক্ত অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়ে যাবেন।
এসব অনিয়ম চলমান অডিট কার্যক্রমের আওতায় এনেছে বিশেষ অডিট টিম। অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, স্যাম্পল বেসিসের মাধ্যমে অডিট চলছে। এরমধ্যে বিষয়গুলো পড়লে অবশ্যই অডিট আপত্তিতে আসবে। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, কর্মকর্তাদের পদোন্নয়ন নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে দুজন ভিসি, ইউজিসি সদস্যও রয়েছেন। অনিয়ম ও কেউ বঞ্চনার শিকার হয়েছেন কিনা কমিটি বিষয়টি দেখবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।