
পতিত সরকারের আমলে ব্যাংক লুটের খেসারত দিতে হচ্ছে ব্যাংকের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। লুটেরা শ্রেণী পালিয়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পাহাড় জমেছে। এর বিপরীতে যে পরিমাণ পরিচালন আয় হচ্ছে তা দিয়ে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এতে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা। আর এর দায় সরাসরি নিতে হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। তারা বছর শেষে প্রাপ্ত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো আলোচ্য সময়ে সংরক্ষণ করতে পেরেছে মাত্র এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এস আলম, বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমান, নাসার নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ আওয়ামী লীগ আমলের ব্যাংক লুটেরা দেশের কিছু ব্যাংক থেকে পানির মতো অর্থ বের করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। একমাত্র এস আলমই ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা, যদিও এটা প্রাথমিক হিসেব। ব্যাংকগুলো থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুট করা হয়েছে তা আর ফেরত দেয়া হয়নি। পতিত আওয়ামী লীগ আমলে পরিশোধ না করেই পরিশোধ দেখানো হতো। এতে আড়াল করা হতো ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর পতিত সরকারের সাথে এস আলমসহ বেশির ভাগ ব্যাংক লুটেরা দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। শুধু অর্থই লুট করা হয়নি, এস আলমসহ অনেকেই তাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর ফলে ওই সব অর্থ এখন খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণই হয়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা খেলাপি ঋণের প্রায় সাড়ে ৮১ শতাংশ। আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি।
প্রসঙ্গত, আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষার জন্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ ব্যাংকগুলোকে সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ অর্থ সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকগুলো মুনাফা থেকে। সাধারণত খেলাপি ঋণভেদে ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে ব্যাংকগুলো বছর শেষে লভ্যাংশ দিতে পারে না বিনিয়োগকারীদের মাঝে।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার ০.৫ থেকে ৫ শতাংশ সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে, নি¤œমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশনিং আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের মোট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ ডিসেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৬৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। তারও আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। এ ছাড়াও গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চে প্রভিশন ঘাটতি ছিল মাত্র ২৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। যা এক বছরের বেড়েছে ৬ গুণ বেশি।
অপর দিকে, মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৫৭ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। তারও আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ২০৪ কোটি টাকা।
তথ্যানুযায়ী গত মার্চ পর্যন্ত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫৮ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা বা দ্বিগুণেরও বেশি। তারও আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা।