
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসাসেবায় দেশের ৪৩০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং ১০ জেলা হাসপাতালে রয়েছে এনসিডি কর্নার। এসব কর্নারে চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার রোগীকে দেওয়া হয় বিনামূল্যে ওষুধ।
কিন্তু সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশন প্ল্যান (ওপি) থেকে সরে আসায় এনসিডি কর্নারে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের রোগীরা। হাতে থাকা ওষুধ ইতোমধ্যে ফুরিয়ে এসেছে। ফলে দ্রুতই এসব জরুরি ওষুধের সংকট দেখা দিতে পারে। তবে সংকট দ্রুত কেটে যাবেÑএমন আশা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৬ মে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যেখানে বলা হয়, মে মাস থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এনসিডি কর্নারে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ থাকবে। এই চিঠি পেয়ে বিপাকে পড়েন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় চাহিদামতো ওষুধ দেওয়া যাচ্ছে না। রোগীদের ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। কবে নাগাদ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে, সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কিছুই জানানো হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, হঠাৎ করেই ওপি বন্ধ হওয়ায় মূলত এমন জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে ওপি বন্ধ, অন্যদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসনের কাছে অর্থ না থাকায় তারাও কিনতে পারছে না। সরকারের উচিত ছিল এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিষয়টি মাথায় রাখা। কারণ বিত্তশালীদের ওষুধ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য থাকলেও তা নেই নিম্ন আয়ের মানুষের।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর আমার দেশকে জানিয়েছেন, সংকট নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ওপি বন্ধ হওয়ায় যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, তার সমাধান সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। শিগগিরই ওষুধ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামো স্থাপন, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, টিকা ও পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০টির বেশি কর্মসূচি পালিত হয় সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনা বা ওপির মাধ্যমে। সর্বশেষ গত বছরের জুনে শেষ হয় ওপি। ওই বছরের জুলাই মাসে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য এক লাখ ছয় হাজার ১০০ কোটি টাকার পঞ্চম এইচপিএনএসপি শুরুর কথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তা অনুমোদন করেনি। আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ওপি থেকে বের হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।
২০১৮ সালে চালু হয় এনসিডি কর্নার। এর অন্যতম লক্ষ্য অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ। এতে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস শনাক্ত, চিকিৎসা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ বিতরণ ও রোগীদের পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের ৪৩০ উপজেলা ও ১০ জেলা সদর হাসপাতালে এনসিডি কর্নার রয়েছে। এসব কর্নারে নিবন্ধিত রোগী ১০ লাখের বেশি। যারা বর্তমানে চাহিদামতো ওষুধ পাচ্ছেন না।
অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সূত্রে জানা গেছে, এনসিডি কর্নারে মূলত ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য মেটফরমিন ও গ্লিক্লাজাইড, উচ্চ রক্তচাপের জন্য অ্যামলোডিপিন, লোজারটেন পটাশিয়াম, হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড ওষুধ দেওয়া হয়। এ ছাড়া হৃদরোগীরা পান অ্যাসপিরিন ও রোজুভাস্টেটিন। ওষুধগুলো সুলভ ও সহজলভ্য হলেও ওপি বন্ধ থাকায় তা নতুন করে কেনা হচ্ছে না। অথচ কর্নারে প্রতি মাসে নতুন করে প্রায় ১০ হাজার রোগীর নিবন্ধন হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো স্বাস্থ্য সমস্যার রোগীদের নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ ও চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। এ দুটি রোগের কারণে হৃদরোগ, কিডনি, ক্যানসারসহ বিভিন্ন অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
সরকারের সর্বশেষ স্বাস্থ্য বুলেটিন বলছে, দেশে সংক্রামক রোগের প্রকোপ ধীরে ধীরে কমলেও উল্টো অসংক্রামক রোগের চিত্র। মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশই হচ্ছে অসংক্রামক রোগে। যার ৩৪ ভাগই ঘটে হৃদরোগে। এ হৃদরোগের বড় কারণ উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস।
গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। উত্তরের প্রত্যন্ত এই হাসপাতালের এনসিডি কর্নারে দৈনিক ২৫-৩০ জন অসংক্রামক রোগীকে ওষুধ দিতে হয়। ওষুধ সরবরাহ বন্ধ হওয়ার খবরে হতাশা প্রকাশ করেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. সাজিয়া আফরিন। আমার দেশকে তিনি বলেন, ওষুধ সরবরাহ বন্ধে আমরা একটি বড় ধাক্কা খেয়েছি। মানুষ যেহেতু আমাদের কাছে আসে, তারা সমস্যা শুনতে চায় না, ওষুধ চায়। কিন্তু সরকার না দিলে তো আমরা দিতে পারি না। বর্তমানে কিছু মজুত আছে, তা-ই দিচ্ছি। তবে বেশি দিন চলবে না।
একই তথ্য জানিয়ে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুবাস সরকার আমার দেশকে বলেন, আমার উপজেলার এনসিডি কর্নারে গড়ে প্রতিদিন ৫০-৬০ রোগীকে ওষুধ দিতে হয়। সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় সব ওষুধ দিতে পারছি না।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন আমার দেশকে বলেন, আগে এনসিডি কর্নারের এসব ওষুধ কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া হতো, এখন থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসনই কিনবেÑএমনই সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে একটু সংকট যাচ্ছে, তবে নতুন অর্থবছর চলে আসায় সামনের মাস থেকেই কিনতে পারবে।