
‘আমাকে সারা রাস্তায় বলে রেখেছে-তুই যদি উলটাপালটা করিস বা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি না দিস, তাহলে তোর ওয়াইফকে নিয়ে আসব। তোকে ইচ্ছামতো মারব। আমাদের এখানে কোনো রুলস নেই বা কেউ কিছু করতে পারবে না।’ গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে নির্যাতনের এমন বর্ণনা দিয়েছেন ২৭ বছর বয়সি এক যুবক। কমিশনের প্রতিবেদনের পঞ্চম অধ্যায়ে তার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তিনি বলেন, ২০২১ সালে পুলিশের বিশেষায়িত কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট তাকে গুম করে। তার কাছ থেকে জোরপূর্বক শিখিয়ে দেওয়া জবানবন্দি আদায়ে ৩২ দিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুম কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সোমবার প্রতিবেদনের কিছু অংশ গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুম ও আটক ব্যক্তিদের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে সরাসরি হুমকি, শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যুর হুমকি, দীর্ঘমেয়াদি গুম, পরিবারের সদস্যদের ক্ষতির শঙ্কা এবং বারবার নির্যাতন করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের নির্ধারিত বক্তব্য লিখে দিয়ে বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে আদালতে বলতে বাধ্য করা হয়েছে। ১৬৪ ধারায় এমন শিখিয়ে দেওয়া জবানবন্দি না দিতে চাইলে তাদের মেরে ফেলা হবে কিংবা আরও গুরুতর সাজানো মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
‘বিচারব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার’ প্রতিবেদনের এ অধ্যায়ে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা, বিশেষ করে আদালত এবং বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কমিশন বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, মামলার ধরন, আইনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রয়োগের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত দমন-পীড়নকে বৈধতা দেওয়া এবং বিরোধী দলকে অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত করতে বিচারব্যবস্থা নিজেদের মতো ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের প্রায়ই তার পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াই আদালতে হাজির করে কথিত জবানবন্দি রেকর্ড করা হতো। একাধিক সাক্ষ্য বিশ্লেষণে কমিশন দেখেছেন, ভুক্তভোগীরা স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে কি না, তা যাচাই করার ন্যূনতম আইনি প্রয়োজনীয়তা মনে করেননি অনেক ম্যাজিস্ট্রেট। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, নির্যাতনকারী অফিসাররা তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রিামান্ডে পাঠিয়ে দিতেন।
ভুক্তভোগীরা কমিশনকে আরও বলেছেন, জোর করে আদায় করা জবানবন্দির সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার কোনো মিল নেই। শুধু জোরপূর্বক নয় বরং নানা জালিয়াতির মাধ্যমে সেসব জবানবন্দি নেওয়া হতো। এসব স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার প্রক্রিয়া যেমন পদ্ধতিগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ ছিল, তেমনই আইনের অপব্যবহারও করা হতো। সব অভিযোগে একই বক্তব্য, যেন আগে থেকে এসব প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। মূলত হুমকি, নিজেদের লিখে দেওয়া বক্তব্য ও আইনজীবীর অনুপস্থিতি এবং বিচারিক জটিলতার সমন্বয়ে নিজেদের দায়মুক্তির পথ তৈরি করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করতেন।
১৮ বছর বয়সি এক ভুক্তভোগী কমিশনকে জানান, ‘একটা কাগজ লিখে দিয়েছেন-এইভাবে এইভাবে তুমি স্বীকারোক্তি দিবা। আর না হলে তোমাকে বাঁচায় রাখব না। যদি স্বীকারোক্তি না দাও, তাহলে তোমাকে মেরে ফেলা হবে।’ আমি প্রথমবার দিতে চাইছিলাম না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ডাক দিয়ে বললেন, আপনাদের আসামি তো ভালো করে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে না। তারপর ওনারা আমাকে বাইরে নিয়ে গেছেন। বাইরে নিয়ে গিয়ে শাসিয়েছেন। আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে কেঁদে কেঁদে বললাম-স্যার, আমাকে আমার ভাইয়ের কাছে যেতে দেন। আমার ছোট ছোট ভাইয়ের জন্য আমার মনটা, প্রাণটা কাঁদছে। আমার মায়ের জন্য কাঁদছে। আমার মায়ের কাছে যেতে দেন। এইভাবে আকুতি করলাম।’ ভুক্তভোগী এই তরুণ ২০২০ সালে সিটিটিসির হাতে গুমের শিকার হন।
আরেক নারী শিক্ষার্থী উল্লেখ করেছেন তাকে নির্যাতনের নির্মম কাহিনি। তার দুই হাত উপুড় করে গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে পুরুষ সদস্যরা লাঠি দিয়ে মারধর করেছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘অনেকটা ক্রুসিফাইড হওয়ার মতো করে হাত দুইদিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখছে। ওরা আমাদের ওড়না নিয়ে নিয়েছিল; আমার গায়ে ওড়না ছিল না। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, অহরহ পুরুষ মানুষ যে কতগুলা আসছে দেখার জন্য এটা বলার বাইরে। মানে তারা একটা মজা পাচ্ছে। বলাবলি করতেছিল যে, ‘এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৮ জনকে এই আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিস্ফোরক পদার্থ আইনে ৫১, অস্ত্র আইনে ৪৩, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৯ জন, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ভুক্তভোগীদের বয়স, পেশা এবং অপহরণের তারিখের মধ্যে ব্যাপক অমিল থাকলেও বেশির ভাগকেই একই আইনের তথা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এতে স্পষ্ট হয়েছে, এসব মামলা দমনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার হয়েছে। এছাড়া এসব মামলার চার্জশিটে ধর্মীয় বিভিন্ন বইকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার ও ‘জিহাদি’ লেখা উদ্ধার করার কথা বলা হতো। এভাবে ধর্মীয় লেখনীকে জঙ্গিবাদের আখ্যান হিসাবে দেখানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশন সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের তথ্য সংগ্রহের পর বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৭৯৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যেখানে মাত্র ৫২টিতে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে সাজা প্রদানের হার মাত্র ৭ শতাংশ। অর্থাৎ, বেশির ভাগ তথা ৯৩ শতাংশ অভিযুক্ত খালাস পেয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় সাজা দেওয়ার হার খুব কম থাকলেও মামলার সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১৭ সালে ৬০০’র কম মামলা ২০২১ সাল পর্যন্ত বেড়ে ১২০০’র বেশি হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা দেখা গেছে ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময়ে প্রতিপক্ষকে দমাতে। একইভাবে ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের প্রতি রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত করে।
প্রতিবেদনের ৮-৯ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ উল্লেখ করা বলা হয়, বিচার বিভাগ সংবিধানের অভিভাবক এবং সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত জনগণের মৌলিক অধিকারের রক্ষক হিসাবে কাজ করে। একটি স্থিতিশীল, স্বাধীন এবং জবাবদিহিমূলক বিচার বিভাগ কেবল গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের জন্যই নয়, বরং টেকসই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কেবল সমন্বিত সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমেই বাংলাদেশ এমন একটি বিচার বিভাগ নিশ্চিত করতে পারে, যা স্বাধীন, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং জনসাধারণের আস্থার যোগ্য। বিচার বিভাগ সংস্কারে, কমিশন বেশকিছু প্রস্তুাব ও সুপারিশ করেছে প্রতিবেদনে।