
দরিদ্র পরিবারের ছেলে সজিব সরদার ভাগ্য ফেরানোর আশায় ইতালি যাওয়ার জন্য গত বছরের ১৮ অক্টোবর দেশ ছাড়েন। পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, স্থানীয় দালাল গোলাম মাহাবুব আলম বোরহানের সাথে ১৬ লাখ টাকা করে মৌখিক চুক্তিতে সে এবং তার চাচাতো ভাই রাকিব সর্দার একই সঙ্গে দেশ ত্যাগ করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের লিবিয়ার জোহারা এলাকায় মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখানে দুই দফা বিক্রির পর নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে ভিটেমাটি বিক্রি করে ৪৬ লাখ টাকা দেন সজীব। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, নির্যাতনে গত ১৯ মার্চ তার মৃত্যু হয়।
পরদিন সজীবের পরিবারের কাছে মৃত্যুর খবর আসে। তবে কোনো মতে প্রাণে বেঁচে দেশে ফেরেন তার চাচাত ভাই রাকিব। গত ২৮ মে সজীবের লাশ দেশে আসে। ঢাকার শাহাজালাল বিমানবন্দরে ছেলের লাশ নিতে এসে শোকে স্তব্ধ হয়ে যান বাবা চাঁন মিয়া সরদার। তিনি বলেন, ঋণের বোঝা এবং সন্তান হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব।
সজীবের লাশ ফেরত আসার পর আরো ১২টি পরিবারের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তাদের সন্তানরাও বিভিন্ন পথে ইতালি যাওয়ার জন্য দেশ ছেড়েছিল। কিন্তু দেশ ছাড়ার পর থেকে বহুদিন হয়ে গেছে তাদের সঙ্গে পরিবারের কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। পরিবারগুলো বলতে পারছে না সাগরে না ডাঙায় আছেন তাদের প্রিয় মানুষ।
সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর লিবিয়ার তুবরুক গেইম ঘর (বন্দিশিবির) থেকে ৩৪ জন অভিবাসী নিয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে ভূমধ্যসাগর হয়ে একটি বোট ছেড়ে যায়। পরিবারের ভাষ্যে, এর মধ্যে ১২ জন বাংলাদেশি ছিলেন। তাদের এখনো কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এদের মধ্যে রয়েছেন— নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সায়াদ হোসেন সাজু, আমজাদ হোসেন, পাবনার এমদাদুল হক, নরসিংদীর রায়পুর থানার মারুফ ভূইয়া ও জুবায়ের আহমদ। বাকিরা বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার সূত্রে জানা যায়, উন্নত জীবন গড়তে ইতালিতে যাওয়ার স্বপ্নে স্থানীয় দালালদের সঙ্গে ১২-১৫ লাখ টাকা মৌখিক চুক্তি করেন ওই ১২ জন। চুক্তি অনুযায়ী ফ্লাইটে ইন্ডিয়া-দুবাই-তুরস্ক-মিশর-লিবিয়ার বেনগাজীতে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে তুবরুক এলাকার গেইম ঘরে রাখা হয় তাদের।
নিখোঁজ সাজুর ভাই জাহিদুল ইসলাম রাজু জানান, ১৯ নভেম্বর সাজু ভয়েস ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানায়, ২১ নভেম্বর তাদের বোটে তুলবে। এই বোটে তার সঙ্গে আরো ৩৩ জন থাকবেন। যার মধ্যে ১২ জন বাংলাদেশি। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই। পরবর্তী সময়ে দালাল আমিরের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও সে ফোন রিসিভ করে না। কয়েক মাস আগে একদিন ফোন রিসিভ করে। ভাইয়ের খোঁজ না পেলে মামলা করব বললে সে বলে, ‘পারলে কিছু করিস, তোর ভাই কোথায় আমি জানি না’। এরপর কল কেটে দেয়।
রাজু আরো বলেন, এখন আমার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ আমার ভাইয়ের চিন্তায়। কোনো কিছু মুখে দিচ্ছেন না। এর মধ্যে লিবিয়া থেকে একজনের লাশ আসার খবর পেয়ে তিনি পাথর হয়ে গেছেন ভাইয়ের চিন্তায়। প্রথমে ১৫ লাখ টাকা চুক্তি হয়। লিবিয়া নেওয়ার পর ভাইকে নির্যাতন করে আরো ১৬ লাখ আদায় করা হয় আমাদের কাছ থেকে।
একই এলাকার নিখোঁজ ব্যক্তি আমজাদ হোসেনের পরিবারেরও একই ভাষ্য।
পাবনার ইমদাদুল হকের স্ত্রী সুলতানা পারভীন জানান, তার স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে গত বছরের ১৫ নভেম্বর। এরপর থেকে আর খোঁজ নেই। যাওয়ার আগে মেয়েকে বলেছিলেন, আসার সময় সুন্দর জামা কিনে নিয়ে আসবেন। মেয়েটা স্কুল থেকে এসে প্রত্যেক দিন বাবাকে খোঁজে। বাবা কখন ঢাকা থেকে আসবে জামা নিয়ে। নরসিংদীর কফিল উদ্দিনের মাধ্যমে ১২ লাখ টাকার চুক্তিতে তিনি ইতালি যাওয়ার জন্য দেশ ছাড়েন। পরে তার সহযোগী ওমর ফারুক অলির কাছে ইমদাদকে রাখা হয়। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন আমরা জানি না। এখন দালালকে কল দিলে রিসিভ করে না, নম্বর ব্লক করে দেয়।
মারুফ ভূইয়ার ভাই কাওসার ভূইয়া বলেন, ১২ লাখ টাকার চুক্তিতে স্থানীয় দালাল আল আমিন আমার ভাইকে ইতালির কথা বলে লিবিয়া পাঠায়। গত বছরের জুনে তাকে নেওয়া হয়। তার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে ১৪ নভেম্বর। এরপর থেকে তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই।
জুবায়ের আহমদের বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে ১২ লাখ টাকার চুক্তিতে আমার ছেলে ইতালি যাওয়ার জন্য দেশ ছাড়ে। তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় ১৩ নভেম্বর। এরপর থেকে তার আর খোঁজ নেই।
তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে দালালদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কেউই কল রিসিভ করেননি। পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইমুতে তাদের ম্যাসেজ পাঠানো হলেও তারা কোনো জবাব দেননি।
অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রা কেন থামছে না এমন প্রশ্নে অভিবাসী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির আমার দেশকে বলেন, ইউরোপের দেশগুলোতে এভাবে যারা যাচ্ছে তারা জানে একবার যদি কোনোভাবে প্রবেশ করতে পারে তাহেলে সে স্থায়ী হয়ে যাবে। এজন্য তারা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত।
কীভাবে এভাবে বিদেশ যাত্রা ঠেকানো যায় সে বিষয়ে এই অভিবাসী বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে গ্রামে-গঞ্জে। বিশেষ করে যেসব এলাকা থেকে এ পথে বেশি মানুষ যায় সেসব এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে এটি করতে হবে। আমাদের ইমিগ্রেশনকেও কঠোর হতে হবে।