
আমার শৈশবের স্মৃতিগুলোর মধ্যে একটি ছিল ১৯৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই আমেরিকার দ্বিশতবর্ষ উদযাপন।আমার নিজ রাজ্য ম্যাসাচুসেটস আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্ববর্তী সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। গত পঞ্চাশ বছরে, আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধের ইতিহাসের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী অন্যান্য বিপ্লব এবং স্বাধীনতা সংগ্রামগুলোও আমি অধ্যয়ন করেছি - যার মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, রাশিয়া এবং আয়ারল্যান্ডের বিপ্লব ।২০২৬ সালে আমেরিকার ২৫০ তম জন্মদিন উদযাপনের কাউন্টডাউন শুরু করার সাথে সাথে, আমি আবারো সেই দেশপ্রেমিক এবং প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের কথা স্মরণ করেছি , যারা স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন , ভাগ্য সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন।

এই ৪ঠা জুলাই, আমি বাংলাদেশের বর্ষা বিপ্লবের এক বছর পূর্তির কথাও ভেবেছি। আমি বুঝতে পারছি যে ইতিহাসবিদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এখনও বিতর্ক করছেন যে বাংলাদেশে গত বছরের জুলাইয়ের দীর্ঘ ঘটনাগুলোকে "বিপ্লব" হিসেবে উল্লেখ করা যায় কিনা, নাকি অন্য কোনও শব্দ ব্যবহার করা আরও উপযুক্ত হবে। আমি এই বিতর্কগুলো শিক্ষাবিদদের উপর ছেড়ে দেব এবং পরিবর্তে সেই সাহসী ছাত্র ও নাগরিকদের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দেওয়ার উপর মনোনিবেশ করব যারা একটি অত্যাচারী শাসককে উৎখাত করতে এবং তাদের সহকর্মী বাংলাদেশীদের একটি উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছিল। একটি বিখ্যাত উক্তি আছে যে, "যারা অতীত মনে রাখতে পারে না, তারা অতীতের পুনরাবৃত্তি করার জন্য নিন্দিত হয় ।" এর অর্থ হল, যারা তাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয় না বা তাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না, তারা আবারও সেই ভুলগুলো করার ঝুঁকিতে থাকে। এটি বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য উপযুক্ত পরামর্শ, যাদের ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আগে দেশটি কেমন ছিল তা মনে রাখা দরকার। এমনকি বাংলাদেশ ২.০ গড়ে তোলার প্রচেষ্টার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার সময়ও এটি তাদের ভুলে গেলে চলবে না ।

এটা কোন গোপন বিষয় নয় যে ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ এক তীব্র ও নৃশংস যুদ্ধের পর স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভুল পক্ষে ছিল। তবে, পরবর্তী দশকগুলোতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম আন্তর্জাতিক সমর্থক হয়ে ওঠে -প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদান করে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে ।যেকোনো সম্পর্কের মতোই , গত অর্ধ শতাব্দীতে ওয়াশিংটন এবং ঢাকার মধ্যে সম্পর্ক চড়াই -উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। যুক্তিসঙ্গতভাবে, এক বছর আগে দু দেশের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল, কারণ হাসিনা সরকার গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতি সমর্থনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার প্রতিনিধিদের সাথে প্রকাশ্যে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করেছিল।জুলাই/আগস্টে ঢাকায় ঘটনাপ্রবাহের দ্রুত পরিবর্তন দেখে বাইডেন প্রশাসনও বিস্মিত হয়ে পড়েছিল। যদিও ওয়াশিংটনে খুব কম লোকই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলো যে ছাত্র বিক্ষোভ হাসিনার পতন ডেকে আনবে। তবুও বাংলাদেশে পট পরিবর্তনের ফলে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা দ্রুত উপলব্ধি করতে পেরেছিল।
শুরু থেকেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রশাসনকে অর্থনৈতিক পতন রোধ, আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নে সহায়তা করার উপায় খুঁজছিল।সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইউনূস এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মধ্যে উষ্ণ আলিঙ্গন ২০২৪ সালের বাকি সময় জুড়ে ধারাবাহিক দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পথ প্রশস্ত করে। বাংলাদেশের মিত্রদের একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক জোটের সমর্থনের মধ্যেও এটি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যা ভারতের কথিত প্রভাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশি সরকার প্রধানদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বকে প্রতিফলিত করে।

ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ক্ষমতার প্রথম ছয় মাস এবং ইউনূস সরকারের প্রথম বছর শেষ হওয়ার পর, এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।বরং, ওয়াশিংটন এবং ঢাকা ব্যক্তিগত ও পারস্পরিক স্বার্থের উপর ভিত্তি করে একটি নতুন সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমেরিকা ফার্স্ট মিলিত হয়েছে বাংলাদেশ ফার্স্টের সাথে। নিশ্চিতভাবেই, সম্পর্কের কিছু দিক পরিবর্তিত হয়েছে। বিশেষ করে একটি নেতৃস্থানীয় উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা।একই সময়ে, আমেরিকার তরফ থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সহায়তা কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে, সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।বর্তমানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য আলোচকরা একটি নতুন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করছেন যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের ভিত্তি গড়ে তুলবে। এটি একটি বৈপ্লবিক উন্নয়ন হবে যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুনরূপে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।
একই সাথে,২০২৬ সালের প্রথম দিকে সংস্কার কর্মসূচি এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে ঐকমত্য অর্জনের অগ্রগতি এই নতুন সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র প্রদান করবে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এবং তার সহকর্মীদের অর্জিত সাফল্যের উপর ভিত্তি করে ঢাকায় নতুন সরকারের জন্য মঞ্চ তৈরী করবে । উপসংহারে বলতে হয় , বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বাংলাদেশি -আমেরিকান প্রবাসীদের ভূমিকার দ্বারা আরও উন্নত হচ্ছে।গত এক বছর ধরে, আমি এমন অনেকের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি যারা ২০২৪ সালের জুলাই এবং আগস্টে বাংলাদেশে বিপ্লবের সময় স্বাধীনতার দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় ছিলেন।তারা জুলাই বিপ্লবের অনুপ্রেরণাদায়ক আদর্শের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক সম্প্রসারণের সুযোগ সম্পর্কে আগ্রহী -বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।নিপীড়নের হাত থেকে পালিয়ে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা সন্ধানকারী অভিবাসীদের সন্তান হিসেবে, আমি গর্বের সাথে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি যারা তাদের জন্মভূমির জন্য একই জিনিস প্রত্যক্ষ করতে চান।
লেখক মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ফরেন সার্ভিস অফিসার। দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। কূটনৈতিক কর্মজীবনে তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
সূত্র : কাউন্টার পয়েন্ট