Image description

ঈদুল আজহা সামনে রেখে দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প গভীর সংকটে পড়েছে। কোরবানির মৌসুমে মৌসুমি চামড়া সংগ্রহে অর্থসংকট, রফতানি হ্রাস, আন্তর্জাতিক বাজার হারানো এবং নীতিগত দুর্বলতার সম্মিলিত চাপ ট্যানারি খাতকে টিকে থাকার কঠিন লড়াইয়ে ফেলেছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) জানিয়েছে, ট্যানারিগুলো এবারের মৌসুমে চামড়া সংগ্রহের জন্য অন্তত ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছিল, অথচ হাতে এসেছে মাত্র ১২৫ কোটি টাকা—যা চাহিদার এক-চতুর্থাংশেরও কম। খাতটির ক্রমাগত অবনতি এবং ঋণখেলাপি বাড়ায় ব্যাংকগুলোর আগ্রহও কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির মৌসুমকে কেন্দ্র করে চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য দেশের ব্যাংকগুলো ২৩২ কোটি টাকার ঋণ দেবে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৮ কোটি টাকা কম। ২০২৪ সালে এ খাতে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল ২৭০ কোটি টাকা। অথচ ২০২২ সালে এই খাতে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪৩ কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে ঋণের এই পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে চামড়া শিল্পে উচ্চমাত্রার ঋণখেলাপি প্রবণতা এবং ব্যাংকগুলোর ক্রমাগত অনাগ্রহ।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করবে।

চামড়া শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকগুলো যে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং অনেকাংশে কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) জানিয়েছে, দেশের কাঁচা চামড়ার বাজারের মোট পরিধি প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা হলেও বর্তমান প্রস্তাবিত ঋণ সহায়তা চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বারবার অনুরোধ জানানো হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

বিটিএ সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ বলেন, ‘২৩২ কোটি টাকায় আমাদের মৌসুমি চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। বাজারের আকারের তুলনায় এটি অপ্রতুল। এর মধ্যে আবার অনেক ঋণ পুনঃতফসিল করা হচ্ছে, নতুন করে টাকার প্রবাহ বাড়ছে না। আগে এই খাতে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৪৫০ কোটি টাকার ওপরে ছিল। কিন্তু এখন অনেক কারখানা খেলাপি হওয়ায় ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে ঋণ কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বলেছি, পুরনো ঋণ বন্ধ করে নতুন করে অন্তত ৪৫০ কোটি টাকার নতুন ঋণ দিতে হবে, না হলে চামড়া সংরক্ষণে বড় সংকট তৈরি হবে।’

চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তারা মনে করছেন, এই খাতে পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রয়োজন কার্যকর ঋণ নীতি, সুস্পষ্ট দায়িত্ব বণ্টন এবং ব্যাংকগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ। অন্যথায়, ঈদের মৌসুমে কাঁচা চামড়ার অপচয় এবং শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি অনিবার্য হয়ে উঠবে।

রফতানিতে ধস, আন্তর্জাতিক বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি ৮.২৪ শতাংশ কমেছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে রফতানি আয় ৩০-৩৮ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারানো, বিশেষ করে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে প্রবেশ বন্ধ থাকাই এর মূল কারণ। এর ফলে রফতানি অনেকাংশেই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চীনা বাজারে চামড়ার দর তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে, যা টেকসই রফতানিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

গত এক দশকে চামড়া খাতের রফতানি আয় প্রায় ১৬ কোটি ডলার কমেছে। ২০১২ সালে যেখানে খাতটি থেকে আয় হয়েছিল ১১৩ কোটি ডলার, সেখানে ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ৯৭ কোটিতে।

পরিবেশ মান, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো ঘাটতি

সাভার ট্যানারি শিল্পনগরীর সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। বেশিরভাগ ট্যানারির নিজস্ব ইটিপি না থাকায় আন্তর্জাতিক পরিবেশ মান অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, সিইটিপি কর্তৃপক্ষ ৮০ শতাংশ বর্জ্য প্রাক-প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পন্ন করতে চাইলেও বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এবং সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।

নীতিগত সহায়তার অভাব ও প্রশাসনিক সংকট

ট্যানারি মালিকরা অভিযোগ করছেন, পোশাক খাতের মতো নীতিগত সহায়তা চামড়া শিল্প পাচ্ছে না। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে খাত পরিচালিত হচ্ছে, উদ্যোক্তাদের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন ঘটছে না। বন্ড সুবিধা, কাঁচামাল আমদানি, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা এবং রফতানি প্রক্রিয়ায় সমন্বয়হীনতা খাতটির প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।

কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্তে বিতর্ক

সরকার আসন্ন কোরবানিকে কেন্দ্র করে তিন মাসের জন্য কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির অনুমতি দিয়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, স্থানীয় সংরক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, এতে দেশের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। রফতানি আয় ৩০-৪০ শতাংশ কমে যাবে, পরিবেশদূষণ বাড়বে এবং হাজারো শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন।

ঈদ উপলক্ষে চামড়ার দাম নির্ধারণ, পরিবহন নিষেধাজ্ঞা

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঢাকায় গরুর কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে প্রতিটি ১৩৫০ টাকা, ঢাকার বাইরে ১১৫০ টাকা। খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২-২৭ টাকা, বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা। চামড়া সংরক্ষণের জন্য ৩০ হাজার টন লবণ বিনামূল্যে সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে ঢাকায় ঈদের দিনসহ পরবর্তী ১০ দিন অন্য জেলা থেকে কাঁচা চামড়া পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য চামড়া যেন স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষিত হয়।

প্রসঙ্গত, অবনতিশীল চামড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ ও শিল্প-সংশ্লিষ্টরা একমত— এখনই কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ না নিলে এ খাত আরও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তাদের মতে, ট্যানারি শিল্পের টেকসই পুনরুত্থান এবং রফতানি সক্ষমতা বাড়াতে জরুরি ভিত্তিতে নিচের কয়েকটি মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:

১. আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশে এলডব্লিউজি সনদ অর্জন

বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোর চামড়া আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি)’ নামে আন্তর্জাতিক পরিবেশমান সনদের অধীন ট্যানারির পণ্য ছাড়া গ্রহণ করছে না। বাংলাদেশে অধিকাংশ ট্যানারি এখনও এই সনদ পায়নি, যার ফলে রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি ট্যানারিকে যথাযথ পরিবেশবান্ধব মান বজায় রেখে এই সনদ অর্জনের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহায়তা এবং অনুদানভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।

২. পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও ইটিপি বাস্তবায়ন

সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে এখনো সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। অধিকাংশ ট্যানারির নিজস্ব ইটিপি নেই। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিবেশ মান মেনে রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু আদালতের নির্দেশনা পালনের জন্য নয়, বরং টেকসই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে দ্রুত পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পূর্ণাঙ্গ ইটিপি স্থাপন ও কার্যকর করা জরুরি। প্রয়োজনে এই খাতে বিশেষায়িত পরিবেশ ফান্ড গঠন করা যেতে পারে।

৩. সহজ শর্তে ঋণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন

ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে মৌসুমি কাঁচা চামড়া সংগ্রহে যে বড় ধরনের আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা পুরো বছরের উৎপাদন ও রফতানি কার্যক্রমে প্রভাব ফেলবে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌসুমি ঋণের বাইরে ট্যানারি শিল্পের জন্য সহজ শর্তে, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প সুদের অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি আধুনিক অবকাঠামো, রিসার্চ ও ডিজাইন ল্যাব, কাঁচামাল সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং ট্রান্সপোর্ট লজিস্টিক উন্নয়ন করতে হবে। এ ছাড়া ‘চামড়া শিল্প উন্নয়ন নীতি’ নামে একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি নীতির প্রয়োজন রয়েছে, যা পোশাক খাতের মতো জাতীয় অগ্রাধিকারভুক্ত খাত হিসেবে চামড়াকে বিবেচনায় নেবে।

৪. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন

ট্যানারি মালিকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ—এই খাতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আমলারা, অথচ শিল্পের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন উদ্যোক্তারাই। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চামড়া শিল্পে সরকার এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে একটি যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এতে নীতিমালা, ভর্তুকি, রফতানি প্রণোদনা এবং আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনের মতো বিষয়গুলো দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। একইসঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণের পর অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা হ্রাস পাবে, তাই এখনই টেকসই রফতানির ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি ব্যবহার, নতুন পণ্যের উদ্ভাবন এবং ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতকে শক্তিশালী করাই এই শিল্পের ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।

সম্ভাবনার মাঝে শঙ্কা

এক সময়ের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প এখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে। তৈরি পোশাকের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে অংশীদারত্ব এখনও ১ শতাংশের নিচে। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, বাস্তবায়নযোগ্য নীতি ও কার্যকর সহায়তা ছাড়া এই খাতের পতন ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।