
জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক চার্জশিট দাখিল করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
রোববার চার্জশিট দাখিলের সময় জুলাই বিপ্লবের সময় হত্যাযজ্ঞ চালাতে কী কী করেছিলেন শেখ হাসিনা তা ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। এসময় আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়। এজলাসে ছিল পিনপতন নীরবতা। ১৩৫ পৃষ্ঠার মূল আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বলা হয়, অপরাধের নিউক্লিয়াস এবং অপরাধীদের প্রাণভোমরা ছিলেন শেখ হাসিনা।
এই বিচারকাজ সারা বিশ্বকে দেখাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালের শুনানি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) তা প্রচার করে।
তিনি বলেন, ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তে ট্রাইব্যুনালের এই কক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেকে শুধু একজন আইনজীবী হিসেবেই নয় বরং ইতিহাসের এক তাজা রক্তাক্ত অধ্যায়ের সশ্রদ্ধ ভাষ্যকার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছেন।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উগ্র বাসনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ্যভূমিতে। জাতির ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই এই বিচার শুরু করা হলো। যেখানে নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র-যুবা, নারী ও শিশু- যারা একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য বৈষম্য ও কোটা পদ্ধতি নামক কু-প্রথার অবসানের দাবিতে অহিংস ও ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
২৪-এর এই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ও সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নিরীহ, নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ এই মামলার অভিযুক্ত আসামিগণ কর্তৃক নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হন। আসামিদের নির্দেশে ও তাদের নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয় হত্যা, অঙ্গহানি, গ্রেফতার, নির্যাতন, গুম, চিকিৎসা প্রদানে বাধা এবং মৃত ও জীবিত মানুষকে একত্রে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো ।
চিফ প্রসিকিউটর আদালতে বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব যা ‘মনসুন রেভুল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামেও পরিচিত। এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল দেড় দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার হরণ ও রাজনৈতিক উগ্রপন্থার মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আসামিদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বৈধ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেওয়া তরুণদের অবিস্মরণীয় জাগরণ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আসামিরা সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ওইসব মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে নির্মূল বা স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভিত্তিক এবং পদ্ধতিগত আক্রমণ চালায়।
এদিন শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং অভ্যুত্থান সময়ের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সর্বোচ্চ শাস্তি ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর। এ সময় প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, আব্দুস সোবহান তরফদার, গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম, বিএম সুলতান মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ :
১. গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য : ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা ও সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে হামলা চালায়। এর মাধ্যমে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করা হয়। এসব ঘটনায় আসামিদের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান না করার অভিযোগ আনা হয়।
২. হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ : শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আন্দোলনকারীদের দমনে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের অধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেন। এর মাধ্যমে আসামিরা অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে।
৩. রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা : ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই হত্যাকাণ্ডে তাদের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্র, অন্যান্য অমানবিক আচরণের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
৪. চানখাঁরপুলে ছাত্র হত্যা : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ছয়জন ছাত্র নিহত হন। এই ঘটনাতেও শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
৫. আশুলিয়ায় হত্যা ও লাশ পোড়ানো : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা, তাদের মধ্যে পাঁচজনের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া এবং একই সঙ্গে গুরুতর আহত একজনকে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ঘটনায় তিন আসামি কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্র, অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।