
লোকমুখে আলোচনার জন্ম দিতে টেনে টেনে লম্বা করে শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণের চেষ্টা করতেন। কখনো বলতেন : ‘জ্বালা, জ্বালা রে জ্বালা, অন্তর্জ্বালা।’ কখনো বলেছেন : ‘পালাব না। কোথায় পালাব? প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব।
ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইসরাতুন্নেসা কাদেরের গাড়িচালক ছিলেন আতিকুর রহমান। মানিকগঞ্জের সিংগাইরে তিনি নির্মাণ করিয়েছেন আলিশান বাড়ি। তাতে ব্যয় হয়েছে কম হলেও দুই কোটি টাকা। ওবায়দুল কাদেরের প্রভাব খাটিয়ে আতিক অবৈধভাবে অর্থ কামাতেন। তারই প্রমাণ এই বাড়ি। আতিকের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাও ছিল জমজমাট। ইসরাতুন্নেসা তাঁর বাহক পাঠিয়ে সওজ অধিদপ্তর, বিআরটিএসহ বিভিন্ন দপ্তরে তদবির করতেন। তাঁর তদবিরে সুফল ভোগকারীরা উপহার দিতেন ইসরাতুন্নেছাকেও। বিআরটিএ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ইসরাতুন্নেছাকে উপহার দিয়ে পদোন্নতিও পেয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের স্ত্রী সেলিনা মোমেনসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর স্ত্রীও উপহার বা অর্থ দিয়ে ইসরাতুনন্নেছার মাধ্যমে বদলি বা পদোন্নতির মতো কাজ করিয়ে নিতেন। ওবায়দুল কাদেরও তা জানতেন।
কাদের মির্জার অপকর্ম : বড় ভাই দলের সাধারণ সম্পাদক—এই পরিচয় পুঁজি করে ছোট ভাই কাদের মির্জাসহ কাদের পরিবারের কাছের ও দূরের লোকেরা আখের গোছাতে থাকেন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তর, নোয়াখালী জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ে তদবির-সুপারিশসহ বহুমুখী অপকর্ম করে তাঁরা বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যান। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল, বিআরটিএ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন নিয়োগ বাণিজ্য থেকে কাদের মির্জা চাঁদাবাজি করতেন। কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট বাজারে ভবন নির্মাণ করতে হলেও তাঁকে চাঁদা দিতে হতো। পৌরসভার নকশা অনুমোদন, বাসস্ট্যান্ড—সর্বত্র চলত তাঁর চাঁদাবাজি। বসুরহাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল মতিন লিটন বলেন, কাদের মির্জার চাঁদাবাজিতে বসুরহাট বাজারের ব্যবসায়ীরা থাকতেন আতঙ্কে।
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পৌর নির্বাচনে ইশতেহার ঘোষণা দিয়ে কাদের মির্জা ভাই ওবায়দুল কাদেরসহ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে আলোচনায় আসেন। ফেসবুক লাইভে ‘সব ফাঁস করে’ দেওয়ার ভয় দেখান ওবায়দুল কাদেরকে। এটা ছিল এক ধরনের নাটক। ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী যাতে কাদের মির্জাকে কমিশন বাণিজ্যে বাধা না দেন, সে কারণে ওই নাটক সাজানো হয়েছিল। এই ফাঁকে ওবায়দুল কাদের মনোনয়ন বাণিজ্য, দলের জেলা-উপজেলা কমিটি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, উন্নয়নকাজ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন বাণিজ্যের প্রতিনিধি বানান কাদের মির্জাকে। পরে ব্যাপক বাণিজ্যে মির্জা কাদের নিজের, স্ত্রী-সন্তানদের নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ গড়েন। ওবায়দুল কাদেরের বাবা মোশাররফ হোসেন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। পরিবার ছিল অতি সাধারণ। দুই যুগের ব্যবধানে এই পরিবার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যায়।
অন্যের জমি দখল করে আওয়ামী লীগ কার্যালয় : কাদের মির্জাকে দিয়ে অন্যের জমি দখল করে বসুরহাট বাজারে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় তৈরি করিয়ে নেন ওবায়দুল কাদের। বাজারে আরডি শপিং মল দখলের হুমকি দিয়ে মার্কেটের মালিক নুর উদ্দিন মো. জাহাঙ্গীরকে জিম্মি করে ৭ শতাংশ জমি বিনামূল্যে নিজের নামে লিখিয়ে নেন মির্জা। পরে তা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নামে দান করে দাতা সাজেন ওবায়দুল কাদের। নুর উদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘ওবায়দুল কাদেরের ক্ষমতার দাপটে কাদের মির্জার লোকজনের ভয়ে এক কোটি ৭৫ লাখ টাকার জমি বিনামূল্যে তাঁদের নামে লিখে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। গত ১৫ আগস্ট ওবায়দুল কাদের ও কাদের মির্জাকে আসামি করে নোয়াখালী দেওয়ানি আদালতে মামলা করেছি।’
কমিশন বাণিজ্য : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেড় দশকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ও বসুরহাট পৌরসভায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হয়। এর মধ্যে পৌরসভায় উন্নয়নকাজ হয় ৯৭ কোটি টাকার। গড়ে ১০ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন কাদের মির্জা। পছন্দের ঠিকাদারের বাইরে কেউ নোয়াখালীতে কাজ করতে পারত না বলে ভুক্তভোগী ঠিকাদাররা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন। ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বসুরহাটের আমিন মার্কেটের মালিক আশিক-ই-রসুলকে পৌরসভা কার্যালয়ে ডেকে মির্জা লোকজনকে দিয়ে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। তা না দেওয়ায় ২৭ সেপ্টেম্বর মার্কেটের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় তাঁর বাহিনী। আশিক-ই-রসুল বলেন, ‘টাকা দেওয়ার পর আমার মার্কেটের তালা খুলে দেওয়া হয়। অন্যদিকে পৌর এলাকায় লন্ডনপ্রবাসী আবু ছায়েদের চারতলা ও ছয়তলার দুটি ভবন পাঁচ বছর আগে দখল করেন মির্জা। চারতলা ভবন মির্জা তাঁর স্ত্রী আক্তার জাহান বকুলের নামে লিখে নেন। দুই ভবনের নিচে দোকান এবং ওপরে আবাসিক ফ্ল্যাট। ছয়তলা ভবন থেকে পৌরসভার নামে ভাড়াও তুলতেন মির্জা। ৫ আগস্টের পর ভবনটি দখলমুক্ত করেন আবু ছায়েদ।’ এলাকাবাসী জানায়, ওবায়দুল কাদের এই দখলবাজির মূল শক্তি ছিলেন। বসুরহাটের ব্যবসায়ী ফেরদৌস মাহমুদ বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে মির্জা নানা ছুতায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিতেন। শত শত দোকান দখল করে পৌরসভার নামে ভাড়া তুলতেন। ওবায়দুল কাদেরের ভয়ে ভুক্তভোগীরা চাঁদা দিতে বাধ্য হতেন। কিন্তু তাঁরা প্রতিবাদ করতে পারতেন না।
হেলমেট বাহিনী : কোম্পানীগঞ্জে ছিল মির্জার হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনী। তার নেতৃত্বে ছিলেন মির্জার ছেলে তাশিক মির্জা। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চাপরাশিরহাটে প্রতিপক্ষের মিছিলে হামলা চালায় এই বাহিনী। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে মারা যান স্থানীয় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। এ ঘটনার মামলায় কারো নাম উল্লেখ করার সাহস পায়নি মুজাক্কিরের পরিবার। উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মাহমুদুর রহমান রিপন বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১০৩টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের অক্টোবরে কোম্পানীগঞ্জে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ৬৯ জন নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা চালায় হেলমেট বাহিনী।’ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে মুছাপুর ক্লোজার এলাকায় মির্জা ৬০০ একরের বেশি খাসজমি দখল করে ভুয়া ভূমিহীন সাজিয়ে তা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। একই এলাকার ছোট ফেনী নদীর বালু উত্তোলন করে বিক্রি করান তিন বছর। ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পৌরসভার কলালিয়ায় মির্জার নেতৃত্বে হুমায়ূন টিম্বার মার্চেন্ট অ্যান্ড সমিলে হামলা চালানো হয়। সেখানে ‘শিশুপার্কের জন্য নির্ধারিত স্থান’ লেখাসংবলিত সাইনবোর্ড টাঙায় সন্ত্রাসীরা।