
‘জালিয়াতি ও লুটপাটে দেশের ১০ ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। কিছু কিছু ব্যাংকের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। একসঙ্গে টাকা তুলতে যাবেন না, তাইলে পাবেন না। জুলাইয়ের মধ্যেই একীভূত হচ্ছে শরিয়াহভিত্তিক ছয় ব্যাংক।’ গত বছরের ১৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর সংবাদ সম্মেলন, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এ রকম নেতিবাচক বক্তব্য দেওয়ার ফলে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন আমানতকারীরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরি বলেন, ‘গভর্নরের কাছ থেকে এমন আশঙ্কার কথা শুনলে আমানতকারীর আতঙ্ক আরও বাড়ে। তাই ব্যাংকের অবস্থা খারাপ বা দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, এমন বক্তব্য গভর্নরের দেওয়া উচিত নয়।’
গভর্নরের নেতিবাচক বক্তব্যের পর আমানতকারীরা ব্যাংকগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন টাকা তোলার জন্য। ব্যাংকের বুথে গিয়ে দেখেন টাকা নেই, কারও অনলাইন লেনদেন বন্ধ, যে ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্ট সেখানে গিয়ে টাকা তোলার মতো ঝক্কিঝামেলার মধ্যে পড়া ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের অভিযোগ গচ্ছিত টাকা নিয়ে তাঁরা উদ্বেগে রয়েছেন। এমন বক্তব্যের পর আমানতকারীদের উদ্বেগ দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টিতে আন্তব্যাংক বাজার থেকে নগদ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন গভর্নর। বলেন, ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেওয়া হবে না। শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসতে বাধ্য হন আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবু সংকট কাটেনি। এখনো আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। টাকা তুলতে অনেকেই তদবির করছেন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। গভর্নর টাকা ফেরত দেওয়ার ঘোষণা দিলেও গ্রাহক আশ্বস্ত হতে পারছেন না। দিনে ৫ হাজার টাকার বেশি দিতে পারছে না একাধিক ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেউ টাকা দিতে পারলেই সব টাকা তুলে নিতে চান এমন গ্রাহক আছে হাজার হাজার। সুতরাং ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখতে বলে নিজেই আবার অস্থিতিশীল বক্তব্য দিচ্ছেন গভর্নর।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর নয়টি দেশে মোট নয়বার সফর করেছেন। তিনি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে নয় দিন; আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সভায় অংশগ্রহণে দুই দফায় ২৭ দিন যুক্তরাষ্ট্র; মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধিবিষয়ক সম্মেলনে ভারতে তিন দিন; এসইএসিইএন গভর্নর সম্মেলনে দক্ষিণ কোরিয়ায় তিন দিন; ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বোর্ডের কাউন্সিল সভায় জিবুতিতে পাঁচ দিন; অর্থনীতি ও রাজস্ব নীতিবিষয়ক আলোচনায় জাপানে ছয় দিন; ইনস্ট্যান্ট পেমেন্ট সিস্টেম ও গ্লোবাল গুড প্র্যাকটিস সম্মেলনে লন্ডনে সাত দিন; গ্লোবাল সুকুক ফোরাম ও চুরি হওয়া সম্পদ উদ্ধারসংক্রান্ত বৈঠকে দুবাইতে পাঁচ দিন সফর করেন; যা অতীতের কোনো গভর্নরের বিদেশ ভ্রমণের তুলনায় অনেক বেশি। অনেকেই বলছেন তিনি গরিবের ব্যাংক খ্যাতি পাওয়া গভর্নরকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
ব্যাংকাররা জানান, আগের কোনো গভর্নরের এত বিদেশ সফরের নজির নেই। এমন অনেক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রতিনিধিত্ব করলেও এবার সরাসরি গভর্নর অংশ নিয়েছেন। এমনকি বেসরকারি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড বা শাখা উদ্বোধনের মতো গুরুত্বহীন অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।
জনগণের করের টাকায় বিদেশ সফরের সুফল ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা জরুরি। সফরের অর্জন, বিদেশে বাংলাদেশের কী স্বার্থ রক্ষা হয়েছে এ প্রশ্নগুলো জনসাধারণের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে। তারা বলেছেন, এখনো পাচারের ১ টাকাও ফেরত আসেনি। এমনকি বিদেশের আদালতে মামলাও করা হয়নি। রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। গভর্নরের নেতৃত্বে আর্থিক খাতে অনেক পরিবর্তনের ছোঁয়া থাকলেও তাঁর ঘন ঘন বিদেশ সফর নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা ও বিতর্ক। জনগণের করের টাকায় সফরের যৌক্তিকতা ও ফলাফল নির্দ্বিধায় প্রকাশের মাধ্যমে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
গভর্নরের এসব সফরের ব্যয় ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক মহল। বিশেষ করে দেশে যখন ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট, নগদ টাকার ঘাটতি ও ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের এমন ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। অনেক বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে প্রতিনিধি পাঠানো যথেষ্ট ছিল, সেখানে গভর্নরের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি প্রশ্নের জš§ দিয়েছে।
যেখানে সমালোচকরা এসব সফর ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ হিসেবে দেখছেন, সেখানে অন্য একদল বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের আন্তর্জাতিক পরিম লে সক্রিয় উপস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক ভাবমূর্তি ও কূটনৈতিক স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ভ্রমণ নয়, সফরের অর্জনই মূল বিষয়। সফরের সুফল, চুক্তি বা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ নিয়ে জনসাধারণকে জানানো এখন সময়ের দাবি।’ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছরের ১৪ আগস্ট যোগদানের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত মোট ৯১ দিন সরকারি ছুটি (শুক্র, শনি, ঈদ, বিভিন্ন দিবস) ছিল। পাশাপাশি তিনি ৬৫ দিন ছিলেন বিদেশে। যোগদানের ২৮৪ দিনের মধ্যে ১৫৬ দিন ছিলেন সরকারি ছুটি ও বিদেশ সফরে। অফিস করেছেন ১২৮ দিন।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গভর্নর বলেছেন, ১০টি দুর্বল শরিয়াহ ব্যাংক একীভূত করে দুটি শক্তিশালী ইসলামি ব্যাংক করা হবে।’ কিন্তু দেশে প্রচলিত ধারার অনেক দুর্বল ব্যাংক আছে যেগুলো নিয়ে গভর্নরের মাথাব্যথা নেই। শুধু ইসলামি ধারার ব্যাংকেই সমস্যা। গভর্নরের এমন বক্তব্যের পরপরই ব্যাংকিং খাতে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে ইসলামি ধারার ব্যাংকের গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। অনেকে মনে করছেন, একতরফা বক্তব্য দিয়ে গভর্নর ব্যাংক খাতে আস্থাহীনতা তৈরি করছেন, যা এক ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক খাত বিশ্লেষকেরা বলেন, ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী স্বাধীনতা ছিল না বললেই চলে। ফলে ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা, অনিয়ম, খেলাপি ঋণ এবং আর্থিক খাতে আস্থাহীনতা চরম আকার ধারণ করেছে। নতুন গভর্নর আসার পর দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেও সে স্বপ্নে পানি ঢেলে দিচ্ছে ঋণের সুদহার, মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের ঘাটতি ও জ্বালানিসংকট।
ড. আহসান এইচ মনসুর যোগ দেওয়ার পর এখন পর্যন্ত চারবার নীতিসুদহার বাড়ানো হয়েছে। এতে ঋণের সুদহার ১৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৮ শতাংশে নেমেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরি জানান, ‘ব্যাংক খাতের অবস্থা যে খারাপ এখন সবাই জানে। তবে গভর্নরের বক্তব্য শুনলে আমানতকারীদের আতঙ্ক আরও বাড়ে। আমার মতে কোনো ব্যাংকের অবস্থা খারাপ বা দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে এমন বক্তব্য গভর্নরের মুখ থেকে আসা উচিত নয়।’ তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনেই গভর্নরকে বিদেশে সফর করতে হয়। তিনিও বেশ কিছু সফরে গেছেন।