
নেই চিকিৎসক, নেই নার্স, নেই কোনো স্বাস্থ্যকর্মী; নেই রোগীদের ভিড় আর হৈচৈও। হাসপাতালের মূল ফটকে পুলিশি পাহারা, হাসপাতালজুড়ে নীরবতা আর আতঙ্ক। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এখন যেন রূপ নিয়েছে ‘ভূতুড়ে’ এক হাসপাতালে।
দেশের প্রধান চক্ষু সেবা প্রতিষ্ঠানটি গত চারদিন ধরে সম্পূর্ণ অচল হয়ে আছে। চিকিৎসাসেবা বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন ভর্তি থাকা শতাধিক রোগী ও হাজারো সেবা প্রত্যাশী। সংকটে পড়েছেন খোদ যাদের কারণে এই সংকট সেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতরাও।
শনিবার (৩১ মে) জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র উঠে এসেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের প্রধান দুটি গেট তালা দেওয়া। পাশে একটি গেট খোলা রাখা হলেও সেখানে বসে আছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা গার্ডরা। তারা কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। কেউ যদি বারবার অনুরোধ করেন, তখনও শুধু একটি উত্তর-হাসপাতাল বন্ধ, আমরা কিছু জানি না।
হাসপাতালের প্রবেশপথে ও ভেতরে অবস্থান করছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা মূলত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। গেটের সামনে, বারান্দা ও করিডোরে দেখা মেলে কয়েকজন জুলাই আহত রোগীর, যারা কোনো সেবা না পেয়ে হাসপাতাল ভবনের সিঁড়ি বা খোলা জায়গায় বসে আছেন।
ফিরে যাচ্ছেন সাধারণ রোগীরা
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট দেশের সর্বোচ্চ চক্ষু চিকিৎসা কেন্দ্র হওয়ায় প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে শত শত রোগী এখানে আসেন। কিন্তু গত চারদিন ধরে চিকিৎসাসেবা না থাকায় সবাইকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে।
কুমিল্লা থেকে আসা গাজী মো. আকতার বলেন, আমার চোখের অপারেশন ১ জুন। সব রিপোর্ট ও প্রস্তুতি শেষ। এখন শুনি হাসপাতাল বন্ধ। আর একদিনের মধ্যে যদি অপারেশন না হয়, তাহলে আবার নতুন করে সব করতে হবে।
তিনি বলেন, আমি এর আগেও আরও দুদিন এসে ঘুরে গেছি। এভাবে শতশত রোগী এসে ভোগান্তিতে পড়ছে। এত বড় হাসপাতাল কীভাবে দিনের পর দিন বন্ধ থাকে? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কি কোনো দায় নেই? জুলাই আহতদের কি স্বাভাবিক কোনো জ্ঞান নেই? সাধারণ রোগীরা এর ফল ভোগ করবে, এটা তো হতে পারে না।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা আরেক রোগী রবিউল বলেন, আমার চোখে চটচটে ভাব, ডাক্তার বলেছেন উন্নত চিকিৎসা দরকার। এসেছি চক্ষু হাসপাতালে, এসে দেখি হাসপাতাল বন্ধ। এর চেয়ে দুঃখের কিছু হতে পারে?
একজন রোগীর স্বজন রিপা আক্তার বলেন, রোগী নিয়ে এসেছি, কোথাও ডাক্তার নেই। ভর্তিও করা হয়নি, আবার নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাও নেই। চরম অসহায় বোধ করছি।
সংকটে জুলাই আহতরাও
এই সংকটেও হাসপাতালে এখন সবচেয়ে বেশি যাদের দেখা যাচ্ছে, তারা জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহত। আগে তাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড ও চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও এখন তারাও পরিণত হয়েছেন অনাহারে-অসুস্থতায় ভোগা সাধারণ রোগীতে। তারা বলছেন, হাসপাতালে থাকা বেশিরভাগ সাধারণ রোগী চলে গেছেন। অল্প কয়েকজন রয়েছে। যাদের অন্য কোথাও যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। আমরা চাই, ডাক্তার নার্সরা ফেরত আসুক। আমাদের জন্য না হলেও সাধারণ রোগীদের জন্য আসুক।
জুলাই আন্দোলনে আহত আবু হানিফ বলেন, সাধারণ রোগী কিছু আছে। আর যারা পাঁচ তলায় ছিলেন, তাদেরকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি, তাদের ফাইল রেখে দিয়েছি আমরা। আবার যখন হাসপাতাল চালু হবে তাদেরকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে এবং ফাইল ফেরত দেওয়া হবে। হাসপাতালে এখন খাবার নেই, চিকিৎসক-নার্স কেউ নেই– এসবসহ নানা সংকট বিরাজ করছে হাসপাতালে। সাধারণ রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কষ্ট আমরা করি, অন্যদের যেন কষ্ট না হয়।
রিপা আক্তার নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, রোগী নিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছি। ডাক্তার-নার্স কেউ নেই। কোনো ওষুধও দিচ্ছে না। রোগীর এমন অবস্থা যে নিয়ে যেতেও পারছি না। আমরা চাই দ্রুত সব স্বাভাবিক হোক।
চিকিৎসক-নার্সরা বলছেন- ভয়, অপমান আর নিরাপত্তাহীনতা
হাসপাতালের একজন নার্স (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, আহতদের আমরা সম্মান করি। কিন্তু কিছু লোক এত খারাপ আচরণ করেন যে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। গালাগালি তো আছেই, কেউ কেউ হাত তুলতেও দ্বিধা করেন না। এত অপমান নিয়ে আমরা কেন কাজে ফিরব?
নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, আহতরা চাইলে বাসা থেকে ফলোআপ নিতেই পারতেন। তাহলে এত সমস্যা হতো না। আমরা চিকিৎসকরা ভয় আর অপমানের মধ্যে পড়ে গেছি।
নেই কোনো দিকনির্দেশনা
হাসপাতাল কবে খুলবে, কীভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে- এসব প্রশ্নে কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।
হাসপাতালের গার্ডরা বলেন, উপর থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি। চিকিৎসক-নার্স কেউ আসছে না। শুধু নিরাপত্তা রক্ষা করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, সবাই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো বার্তা ছাড়া এখন আর কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছে না।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলমের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
ডাক্তার-নার্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই চালু হবে চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট
সংকটময় মুহূর্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান।
ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, আমরা আজ সকালে আহতদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছি, যাদের তারা গ্রহণযোগ্য মনে করেন। তাদের উদ্দেশ্য আহতদের সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসক-নার্সদের নিরাপত্তা ও সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, আজ সকালেই হাসপাতালের একটি স্বাস্থ্যকর্মী দল আহতদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা উল্টো কর্মীদের ব্যক্তিগত তথ্য, বাসার ঠিকানা জানতে চায়। এসব ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আহতদের পক্ষ থেকে যদি স্পষ্টভাবে জানানো হয় যে তারা আর কোনো উশৃঙ্খল আচরণ করবেন না এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহযোগিতা করবেন, তাহলে চিকিৎসক-নার্সরা কাজে ফিরবেন। চিকিৎসকদের তো রোগীদের সঙ্গে কোনো শত্রুতা নেই—তারা তো মানুষের সেবা করতেই এসেছেন।